
ছবি: সংগৃহীত।
গোপালগঞ্জের সন্তান, চট্টগ্রামে কর্মরত র্যাবের সিনিয়র এএসপি পলাশ সাহার আত্মহত্যার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় চলছে। এবার ঘটনার কয়েক দিন পর মুখ খুললেন তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। ফরিদপুর শহরের বাবার বাড়িতে বসে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে খোলামেলা আলাপে সুস্মিতা তুলে ধরেন তাদের দাম্পত্য জীবনের কিছু না-বলা অধ্যায়।
সুস্মিতা বলেন, ওর (পলাশ সাহা) মা আমাকে সংসার করতে দেয়নি। আমার স্বামী আমার হাতের রান্না ভালো খেতো বলে আমার শাশুড়ি আমার রান্নাবান্না করা বন্ধ করে দিলো। আমার শাশুড়ির পরিকল্পনা ছিলো ছেলে বিয়ে করবে, তাড়াতাড়ি বাচ্চা হয়ে যাবে, বউ সংসার আর বাচ্চা নিয়ে থাকবে, আর সে তার ছেলেকে নিয়ে থাকবে।
আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে এক সঙ্গে কথা বলতে দিতো না। দিনের মধ্যে যতটুকু বাসায় থাকার সুযোগ পেতো ততটা সময় আমার শাশুড়ির সঙ্গে থাকতো। কিন্তু আমি কিছু মনে করতাম না। সংসার কেবল মাত্র শুরু করেছি হয়তো একদিন না এতদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এই একদিন দিনে পর দিন হতেই থাকল, আমার স্বামীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। ও ওর মাকে সময় দিতো, আমাকে আর সময় দিতো না।
আমার স্বামীর ৩৫ বছর বয়স, যে দিন মারা গেলো সেদিন সকালেও আমার শাশুড়ি তাকে খাইয়ে দিয়েছে। আড়াই বছর ধরে দেখছি একটা বাচ্চা ছেলের মত ওর মা দেখাশোনা করছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে ও কি পোশাক পড়বে, কি পোশাক কিনবে, ও কোনটা পড়ে অফিসে যাবে কি যাবে না, ও কখন কি খাবে, কখন ঘুমাবে, কখন ঘুম থেকে উঠবে সবটা ওর মা করে ও বলে দিতো। আমার স্বামীও সেটাই মেনে নিতো।
এই আড়াই বছরে পলাশের মা সকালের নাস্তা তৈরি করতো, আমাকে করতে দিতো না। আমার শাশুড়ি প্রথম ৬ থেকে ৭ মাস আমাকে অনেক যত্ন করেছে। আমি ভাবতাম আমি যদি ওর মাকে ভালোবাসি তাহলে ও ভালো থাকবে সেজন্য আমি প্রথম ৬ থেকে ৭ মাস অনেক করেছি।
আমার স্বামীর (পলাশ) পছন্দ ছিলো যারা সোনা, গহনা, অনেক যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না সে রকম মেয়ে পছন্দ তার। কিন্তু আমার স্বামী নির্লোভী ছিলো, ও সৎ ছিলো, ও আমাকে প্রচণ্ড পছন্দ করতো। ও আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। কিন্তু বিয়ের পর ও অনেক মাতৃভক্ত ছিলো। ওর মাতৃভক্তি প্রচুর ছিল। আমিও সেটি মেনে নিয়েছিলাম, কারণ আমিও একদিন মা হবো। তাহলে আমার সন্তানটাও ওর মতো হবে। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখলাম দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে। আমি ওদের খুব যত্ন করতাম, ওকে ওর মাকে, কিন্তু ওরা আমাকে বুঝতো না। আমার স্বামী আমাকে প্রচুর ভালোবাসতো। ওই যে একটা বয়সের পার্থক্য, আমাকে বুঝতো না।
বিয়ের ৬-৭ মাস পর থেকে বলা শুরু করি, কোনো সমস্যা বা তোমার মানসিকতা এমন কেন, তুমি পছন্দ করে এনেছো, আমি তো হেঁটে আসিনি। তোমার কি ইচ্ছা করে না, বউকে নিয়ে একটু থাকি বা বউকে আলাদা করে একটু সময় দেই। কিন্তু ও বলতো বউকে আলাদা করে সময় দেয়ার কি আছে, মা আছে, আমি আছি, তুমি আছো যা করবো একসঙ্গে করবো। বউকে তো রাতে ভালোবাসা যাবে, রাতে তো বউয়ের সঙ্গে ঘুমাই, তখনই ভালোবাসবো। কিন্তু আমি বলতাম বউকে কি শুধু রাতে ভালোবাসার জন্য, ঘুমানোর জন্য বিয়ে করে, বউয়ের কোন শখ আহ্লাদ থাকে না।
আমার একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হলো এটা একটা টকসি, আমি তো ওর স্ত্রী, আমার নিজস্ব একটা সত্ত্বা আছে, আমি নিজের পরিচয় নিয়ে ভুগতে ছিলাম। আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলাম না ওদের মাঝে। ওরা দুজনে কথা বলতো মা ছেলে। আমি যখন ওদের মাঝে যেতাম ওরা চুপ হয়ে যেতো, এটা কেমন ব্যবহার। আমি তো ওর স্ত্রী, ঘরের ভিতর আমরা মাত্র তিনটা মানুষ ছিলাম।
আমার স্বামীকে আমিই প্রথম বলেছি মা যেহেতু গ্রাম থেকে এসেছে তাই মাকেই মাস্টার রুম, অ্যাটাস্ট বাথরুমটা মাকে দাও, পরিবেশটা মানাতে সহজ হবে। ওর মা ওর জন্য রান্না করতো ও যতটুক খেতে পারবে ততটুকু। এরপর থেকে আস্তে আস্তে আমার মনে মধ্যে পেইন হতে শুরু করলো এটা কেমন ব্যবহার। ওর চলে যেতো অফিসে তারপর আমি ও শাশুড়ি মার জন্য আবারো সকালের নাস্তা তৈরি করতাম আলাদাভাবে। ওর মা যদি তরকারী রান্না করতো শুধুমাত্র পলাশের জন্য রান্না করতো।
উল্লেখ্য, গত ৭ মে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও র্যাব ক্যাম্পে নিজের অফিসকক্ষে নিজের সার্ভিস রিভলভার দিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন এএসপি পলাশ সাহা। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বছর। পরদিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
উৎস: চ্যানেল24
নুসরাত