
ছবি : সংগৃহীত
চাঁদপুরের মতলব উত্তরের প্রতিটি গ্রাম, অলিগলি, রাস্তার ধারে এখন শুধুই সোনালুর রঙিন রাজত্ব। সবুজ পাতা ছাপিয়ে সোনালি রঙের ফুলে সেজেছে সোনালুগাছ। প্রতিটি গাছের গা থেকে যেন হলুদ ঝরনা নেমে এসেছে।
সোনালু ফুল প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অপরূপ ডানা মেলে সেজেছে নতুন রূপে। সূর্যের আগুনঝরা রোদে যেন সোনালি রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনালু ফুল। কিশোরীর কানের দুলের মতো মৃদু বাতাসে দুলছে। হলুদের আভা মাতোয়ারা করে রেখেছে চারপাশ। সবুজ কচি পাতার ফাঁকে ঝলমলে ফুল প্রকৃতিকে যেন সাজিয়ে তুলেছে নিজের মতো করে। সবুজ পাতা ছাপিয়ে সোনালি রঙের ফুলে সেজেছে সোনালুগাছ, যার হলুদ উজ্জ্বল রূপ পথগুলোকে শোভিত করেছে।
সোনালুর এই অপরূপ সৌন্দর্য যেন প্রকৃতির এক নীরব ভাষা, যা বলে দেয়— প্রকৃতিকে যত ভালোবাসা যায়, সে তত বেশি ফিরিয়ে দেয়।
তীব্র গরম আর কাঠফাটা রোদে হলুদের অপরূপ দৃশ্য যেন ক্লান্ত পথিকের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। হলুদ ফুলের চোখজুড়ানো সৌন্দর্যের সমাহার, যা সবার মনে দাগ কেটে যায়।
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় পথেঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে, গাছে গাছে ঝুলছে থোকায় থোকায় সোনালু ফুল— যার অপরূপ সৌন্দর্য আলোকিত করছে চারপাশ।
এই গাছটি গ্রীষ্মের প্রকৃতির সৌন্দর্যের একটি বড় অংশ দখল করে রাখে। এমনকি বসন্তেও এর ফুলেল রূপ দেখা যায় না। সমস্ত বসন্ত হলো এর প্রস্তুতিকাল। পুরো বসন্ত জুড়ে প্রস্তুতি নিয়ে বৈশাখের শুরুতে— ইংরেজি এপ্রিল/মে মাসের দিকে এই হলুদ সোনালু ফুল ফোটা শুরু হয়। এর হালকা মিষ্টি সুবাস প্রজাপতি, মৌমাছি, পাখিদেরও কাছে ডেকে আনে।
বাংলাদেশ, ভারতসহ পূর্ব এশিয়ায় এই গাছটির দেখা মেলে। সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি সোনালুগাছের পাতা ও বাকল বিভিন্ন ভেষজ গুণসম্পন্ন। সোনালুর ফল লাঠির মতো গোল এবং আকারে বেশ লম্বা হয়। তাছাড়া ফুল, ফল ও পাতা বানরের খুব প্রিয়।
সোনালু ফুল গাছ ১০ থেকে ২০ মিটার উচ্চতার হয়ে থাকে। এ ফুল দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি এর রয়েছে নানা বাহারি নাম। পরিচিত নামগুলো হলো— সোনালু, সোনাইল, সোঁদাল, বান্দরলাঠি ইত্যাদি।
একসময় মতলব উত্তর উপজেলার পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্য সোনালুগাছ চোখে পড়ত। কয়েক দশকের ব্যবধানে তার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে।
উপজেলার সুজাতপুর, কলাকান্দা, এখলাছপুর, সাদুল্ল্যাপুর, ফরাজীকান্দি ও ছেংগারচরসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, পথের ধারে, ঝোপঝাড়ে এখনো কিছু সোনালুগাছ চোখে পড়ে। এ গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয়। বেড়ে ওঠার সময় তেমন চোখে না পড়লেও ফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই সবার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, প্রশান্তিতে হৃদয়-মন ও চোখ জুড়িয়ে যায়।
সোনালু ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে উঠেছেন এলাকাবাসী। পথচারী থেকে শুরু করে শিক্ষক, কৃষক, ছাত্র— সবার মুখেই এখন সোনালুর কথা।
উপজেলার ৯নং দক্ষিণ ব্যাসদী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোসাম্মৎ জেসমিন আক্তার জানান, “সোনালু ফুল মানুষের মনে প্রশান্তি আনে। এর কাঠ অনেক মূল্যবান। বিলুপ্তপ্রায় এই গাছ নতুন করে লাগানো প্রয়োজন। যে গাছগুলো এখনো টিকে আছে, সেগুলো রক্ষার দাবি জানাই।”
শরীফ উল্লাহ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, “প্রতিদিন স্কুলে আসার পথে রাস্তার ধারে সারি সারি সোনালুগাছ দেখি। হলুদ ফুলে ঝুলে থাকা সেই গাছগুলো যেন চোখ ধাঁধানো এক ছবি। ছাত্ররাও এসব গাছ দেখে মুগ্ধ হয়। আমি মনে করি, এই গাছ শুধু পরিবেশ নয়, শিক্ষার্থীদের মননেও প্রভাব ফেলে।”
আদুরভিটি গ্রামের কৃষক আয়নাল আখন (৫০) জানান, “আমি নিজে কয়েক বছর আগে দুটো সোনালুগাছ লাগাইছিলাম বাড়ির পাশে। এখন দেখি সেই গাছগুলা সব দিক থেইকা ফুলে ভরা। অনেকে এসে ছবি তোলে, গাছের নিচে বসে। এই ফুলের সৌন্দর্য তো বর্ণনা করার মতো না।”
ছেংগারচর সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিম আক্তার বলেন, “আমরা বন্ধুরা মিলে প্রতিদিন বিকেলে সোনালুগাছের নিচে আড্ডা দিই, ছবি তুলি। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আগে এভাবে চোখে পড়েনি।”
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ফয়সাল মোহাম্মদ আলী বলেন, “সোনালুগাছগুলো পরিবেশের জন্য উপকারী ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সোনালু একটি পরিবেশবান্ধব ফুলগাছ। এটা শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, পাখি ও মৌমাছির জন্যও উপকারী। পাশাপাশি এর ফুল চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন হওয়ায় শোভাবর্ধনকারী হিসেবে পরিচিত। এই গাছ থেকে ভালো মানের কাঠও পাওয়া যায়। আমরা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সোনালুগাছ রোপণে উৎসাহ দিচ্ছি। এমন উদ্যোগে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি পর্যটনের সম্ভাবনাও বাড়বে।”
সা/ই