ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১

বৈষম্য নিরসন ও সংস্কার নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনা

মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৯:৫৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বৈষম্য নিরসন ও সংস্কার নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনা

৫ আগস্ট (২০২৪) সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে কোটাভিত্তিক বৈষম্যর সরণি ধরে এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ঘটে যায় এবং এতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা হতাহত হয়। মূলত বিগত সরকারের সময়ে বৈষম্যসহ অত্যাচার, অনাচার ও অবিচার এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, সারাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। আর তাই কোটাভিত্তিক আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ হয়ে বিপ্লব ঘটায়। সাধারণত বিপ্লবের পর বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে প্রতিবিপ্লব না হলেও খণ্ড খণ্ড ঘটনা কম ঝুঁকিতে ফেলেনি। যাহোক, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য নিরসন বা রোধকল্পে সংস্কারের প্রশ্ন উঠে আসে। সেহেতু ৫ আগস্টের পর ৩৭ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের  প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা দেন। আর এরই জের ধরে সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য সংস্কারের বিষয়ে কার্যক্রম পরিলক্ষিত হতে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, সংস্কার অত সহজসাধ্য নয়। বস্তুত বছরের পর বছর ধরে বৈষম্য এতটা শিকড় গেড়ে বসেছে যে, সহজে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। কেননা, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এখনও ছদ্মবেশের আড়ালে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অব্যাহত রেখে চলেছে।
মূলত বৈষম্যর ইংরেজি শব্দ হলো ‘উরংপৎরসরহধঃরড়হ’, যা এসেছে ল্যাটিন শব্দ ফরংপৎরসরহধৎব থেকে। এর অর্থ হলো, বিচ্ছিন্ন করা অথবা পার্থক্য বা প্রভেদ করা। এদিকে তাত্ত্বিকভাবে বৈষম্য বলতে উল্লেখ্য যে, গুণসম্পন্ন লোকদের নিগৃহীত করা; কিংবা যথাযথ কর্মদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কর্মের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে রাখা বা কর্তৃত্ববাদ হয়ে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে, আগে যা ছিল সেক্ষেত্রে নব্য প্রায়োগিক বাস্তবসম্মত সঠিক পরিমার্জনই হলো সংস্কার (জবহড়াধঃরড়হ)। অবশ্য সংস্কারের বাংলা অর্থ মেরামত বা সঠিকভাবে প্রতিস্থাপন করা। এদিকে সংস্কারের নেপথ্যে যে বিষয়টি ভূমিকা পালন করে, তা হলো যৌক্তিকতা (জধঃরড়হধষরুধঃরড়হ)। আর এর অর্থ হলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রকারান্তরে পুনর্গঠিত করা।
এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সবক্ষেত্রেওই বৈষম্য সৃষ্টি হয়। এদিকে নাগরিকের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা রক্ষা এবং বৈষম্যহীন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ নির্মাণে সকল প্রকার বৈষম্য ও সামাজিক অনিয়ম-অবিচার এবং অসাম্য দূর করে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় গ্রহণ করার শপথ নিয়ে শুরু হয়েছে বৈষম্যবিরোধী রাষ্ট্র সংস্কার। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের ম্যাগনাকার্টা হলো রাষ্ট্র সংস্কারের একটি অনন্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, ১২১৫ সালের ১৫ জুন স্বৈরাচারী ব্রিটিশ রাজা জন সামন্তদের চাপে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যার প্রধান শর্ত স্থানীয় প্রতিনিধিদের অনুমতি ছাড়া রাজা নাগরিকের স্বাধীনতা ও সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। আর এই ম্যাগনাকার্টা সৃষ্টি তো স্বাভাবিকভাবে হয়নি। এটি তো ছোটখাটো একটি বিপ্লবের সারথি ধরে তৈরি হয়েছে। আসলে ম্যাগনাকার্টা হলো রাজার ক্ষমতা খর্ব করার একটি ঐতিহাসিক দলিল; যা ১২১৫  সালের ১৫ জুন স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে ম্যাগনাকার্টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, একে বর্তমান সাংবিধানিক শাসনের সূচনা দলিল বললে ভুল হবে না। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, ১১৮৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি সব অস্থাবর সম্পত্তির ওপর কর ধার্য করেন। কেননা, যুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভার রাজার ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিল যে, অতিরিক্ত কর ধার্য করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। অন্যদিকে, তাঁর পুত্রদ্বয় রিচার্ড এবং জন ছিলেন স্বৈরাচারী। এর মধ্যে বেশ কয়েকবছর অতিবাহিত হয়ে যায়। রাজা দ্বিতীয় হেনরি মৃত্যুবরণ করেন। আর তাঁর মৃত্যুর পর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জন ইংল্যান্ডের রাজা হন। কিন্তু তাঁর স্বেচ্ছাচারমূলক কাজের জন্য পাদ্রী ও ভূস্বামীরা অতিষ্ঠ হয়ে রাজার ক্ষমতা সংকোচনের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। ১২১৫ সালে রাজা জন সামন্তদের চাপে পড়ে রাজার অধিকার সংক্রান্ত যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, সেটাই ম্যাগনাকার্টা। আর এই চুক্তির কারণে রাজাকেও হতে হয়েছিল নিয়মের অধীন। এর শর্তগুলোর মধ্যে প্রধান যেটি ছিলÑ তা হলো স্থানীয় লোকদের প্রতিনিধির অনুমোদন ছাড়া রাজা কারও স্বাধীনতা বা সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এদিকে এই চুক্তির সুপ্রভাব শুধু ইংল্যান্ডেই নয়। অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। মজার বিষয় হলো যে, ক্ষমতা লিপ্সু রাজা জন সহজে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে চাননি। কিন্তু সকল সামন্ত মিলে রাজা জন’কে লন্ডনের কাছে এক দ্বীপে বন্দি করে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। মূলত এই চুক্তি বিচার বিভাগকেও অনেকটা নিরপেক্ষ করছিল। এই দলিলটিই সে দেশের অন্যতম সাংবিধানিক দলিল। প্রজাদের অধিকার ও রাজার ক্ষমতা হ্রাসের যৌক্তিক এই দলিল পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুদেশে মানবাধিকার ও জনগণের ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। আসলে নিজের খুশিমতো জোর করে নাগরিক সমাজের সম্পত্তি আত্মসাৎ বা করায়ত্ত করার সেই অনৈতিক কাজ রাজার আর থাকে না। এটি ৬৩টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত ৪ হাজার শব্দের এক সমৃদ্ধ দলিল। শতশত বছর ধরে ইংরেজ জাতি এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ এই মূলনীতি অনুসরণ  করে চলেছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বিল অব রাইট লেখা হয়েছে এর ওপর ভিত্তি করে। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাতেও প্রতিফলিত হয়েছে এর ধারণাসমূহ। সরকারের শাসনের রশি টেনে ধরার ক্ষেত্রে একে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয় এবং ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বাইবেল নামে খ্যাত এই ম্যাগনাকার্টা। আর এ প্রেক্ষাপটে প্রায় সারে ১৪শ’ বছর আগে মদিনা সনদের গুরুত্ব ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস হবস এক্ষেত্রে বলেন যে, মানুষের নিরাপত্তার জন্য এটি সামাজিক চুক্তি বই কিছু নয়। তাছাড়া এটি সংস্কারের ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত।
এদিকে সীমিত স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নাগরিকের প্রতিনিধিত্বের লক্ষ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশের সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংস্কারের দাবি আসে। এক্ষেত্রে ১৯০৯, ১৯১৯ এবং ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ভারত নামে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হয়। তাছাড়া পাকিস্তানি শাসনামলে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ১৯৫৪; সংবিধান প্রণয়ন ১৯৫৬; শিক্ষা আন্দোলন ১৯৬২; ছয় দফা ১৯৬৬ এবং যুগপৎ ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আসলে রাষ্ট্র সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামত অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। আর সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা বারবার উঠে আসছে, তাহলো ‘রাষ্ট্র সংস্কার’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সংস্কার হলো সাংবিধানিক সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন প্রশাসনের আইনি সংস্কার, বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ রাখার সংস্কার। তাছাড়া বাজেট, ব্যাংক, শেয়ার বাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনগুলো এবং সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাঠামোরও সংস্কার। এছাড়া বৈষম্যরোধে সকল ক্ষেত্রে সমতা আনায়ন, ইত্যাদি।
বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আকাক্সক্ষা হলো, গণতন্ত্র এবং সুশাসন। কিন্তু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জনগণের সমন্বয়হীনতার অভাব এবং এককেন্দ্রিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক এ্যানাটমিকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই জটিল পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশের আপামর জনতাকে সম্পৃক্ত করে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন। একই সঙ্গে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংস্কার করে পরিশুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
একই সঙ্গে বৈষম্যহীন মূল্যবোধ প্রচারের জন্য গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলো মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরতে পারে কর্তৃপক্ষের কাছে এবং তথ্য ও ভাবনা বিনিময়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে; তার নিশ্চয়তা বিধান করা। এদিকে বিচার বিভাগ সুষ্ঠু ও স্বাধীনভাবে বিচার কার্যপরিচালনা করবে। এটাই সবার প্রত্যাশা। অথচ দুঃখের বিষয় হলো যে, স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা বলা হলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেশের বিচারবিভাগকে রাজনীতির বলয় থেকে বের করা যায়নি। ফলে, বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে আইনজীবী নিয়োগসহ ইত্যাদিতে বৈষম্য ও পক্ষপাতিত্বের নেতিবাচক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশ যে প্রশাসন ব্যবস্থা লাভ করেছে, তা ছিল মূলত উপনিবেশিক ধাঁচের। প্রশাসনিক সংস্কার ছাড়া সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা বাড়ানো সম্ভব নয়। কেননা, প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্তরালে দুর্নীতি মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। কারণ, দেশের প্রায় প্রতিটি স্তরে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অপব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে, যা প্রশাসনের দক্ষতা ও স্বচ্ছতাকে ব্যাহত করছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতার অভাব ও অর্থের অপচয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই সঙ্গত কারণেই প্রশাসন ব্যবস্থাকে সংস্কারের মাধ্যমে ঢেলে সাজানো অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতদ্ব্যতীত আমরা জানি যে, শিক্ষা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। অথচ স্বাধীনতাউত্তর কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করা হলেও কার্যকরী শিক্ষার অভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে। বস্তুত, দেশে শিক্ষার একটি বড় সমস্যা হলো সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষাক্রম চাপিয়ে দেওয়া; মাধ্যমিকে বিভাজন নিয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া; কারিগরি তথা কর্মমুখী শিক্ষাকে সমানভাবে গুরুত্ব না দেওয়া এবং বিভিন্ন বিভাজন থাকা। তাই বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষার নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশ বজায় রেখে অতি দ্রুত শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো আবশ্যক।
বৈষম্যরোধে যে সকল দেশ সংস্কার করে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করেছে, এমন কিছু রাষ্ট্রের উদাহরণ তুলে ধরছি। দেশগুলো হলো- দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ (নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ড) রুয়ান্ডা, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি। উক্ত প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সংস্কার চালিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাম্যের ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠন করা। তারা অনেকাংশে সফল হয়েছে।
আর তাই অধুনা বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ব্যাপক আশা-আকাক্সক্ষার জন্ম নিয়েছে। এ বিষয়ে এখন প্রায় সবাই একমত যে, বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রীয় সংস্কার করা অপরিহার্য। ছাত্র-জনতা বলতে গেলে সবাই এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চেয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। তারা আর কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার বা একনায়কতন্ত্র দেখতে চায় না বিধায় এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোনো সংশয় নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে বৈষম্য দূরীকরণে করণীয় কার্যক্রমের বিষয়ে উল্লেখ্য, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ করতে একটি শক্তিশালী যৌক্তিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সরকারি পরিষেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির আরও বিস্তৃত ব্যবহার করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে। বহির্বিশ্ব থেকে আসা চাপ বা উসকানির মোকাবিলায় কৌশলী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য আরও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের বস্তুনিষ্ঠ প্রস্তাব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও উদার হতে হবে, যাতে সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত করে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো শক্তিশালী করতে হবে।
পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, এই ধান-শালিকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যসহ নানা নেতিবাচক প্রপঞ্চ এত গভীর পর্যন্ত প্রোথিত যে, সহজে সংস্কার করা সম্ভব নয়। এর মধ্যে কিছু কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাই বর্তমান সরকারসহ দেশের আপামর জনসাধারণকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা পদে পদে হোঁচট খেতে হবে, যার আলামত ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। আরেকটি কথা হলো, সংস্কার  হও বললে  আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। এর জন্য পর্যাপ্ত সময় আবশ্যক।

লেখক : বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ
[email protected]/w.goonijon.com

মোহাম্মদ আলী

×