কম এডিপি বাস্তবায়ন
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সরকার খরচ করেছে ১৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই হার ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং একই ধারা চললে বার্ষিক বাস্তবায়নের হারেও রেকর্ড হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুসারে, গত অর্থবছরের একই সময়ে উন্নয়ন খরচের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, যা ছিল এডিটি বাস্তবায়নের সাড়ে ৭ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরে মহামারির মধ্যেও একই সময়ে এই হার ছিল ৮ শতাংশের বেশি। পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক বিদেশী ঠিকাদার দেশ ছাড়ায় এডিপির অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রভাবে এমনটা হতে পারে। তা ছাড়াও এমনিতেই প্রতি বছর এডিপি বাস্তবায়নের কম হার দেখা যায়। আর এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব পর্যালোচনায় ধীরগতিতে এগোচ্ছে। সরকার পতনের পর গত তিন মাসে প্রশাসনেও ব্যাপক রদবদল হয়েছে, পতিত সরকারের আনুুকূল্য পাওয়া ঠিকাদাররাও এখন পলাতক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিও অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ। এ সবই সামগ্রিক এডিপি বাস্তবায়নের হার কমিয়ে দিয়েছে।
এডিপি বাস্তবায়ন হার কম হলে অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি থেকে যায়। প্রকল্প অর্থায়নের জন্য ব্যাংক থেকে সরকার অতিরিক্ত ঋণ নিলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বেসরকারি খাতের বিকাশও থমকে যেতে পারে। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সুদের হার বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের ঝুঁকি না নেওয়ায় কর্মসংস্থান পরিস্থিতি এখন বেশ চাপে আছে। অপরদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি সাধারণ মানুষ বেশ কষ্টে আছে। সরকারের খরচ করার প্রবণতা কমে গেলে সাধারণ চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে।
দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হারের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সংকটজনক অর্থনীতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সতর্কভাবে খরচ করা। এটি প্রত্যাশিত ও সাধুবাদযোগ্য। পাশাপাশি সংস্কারসহ নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তায় এডিপি বাস্তবায়নের হার কমেছে। জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও সম্পদের অভাব ও উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হওয়ায় এডিপির সামগ্রিক বাস্তবায়নের হারে অনুমিতভাবেই প্রভাব পড়েছে। যদিও সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের সঙ্গে অনেক বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, পণ্য উৎপাদনকারী ও শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয় জড়িত।
মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাব-নিকাশেও এডিপি বাস্তবায়ন প্রভাব ফেলে। তবু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সব দিক বিবেচনা করে অত্যন্ত সতর্কভাবে অর্থ খরচ করে এডিপি বাস্তবায়ন ১ বছরে ১০ শতাংশও করে, তা হলে বিদ্যমান অবস্থায় খুব একটা অন্যায় কিছু হবে না। এডিপি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরে চলো নীতি অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ীদের ত্রিমাত্রিক দুর্নীতির মহোৎসবে পরিণত হওয়া এডিপির সরকারি প্রকল্পগুলো হয়ে উঠেছে জনগণের অর্থ নয়-ছয়ের অন্যতম হাতিয়ার।
সরকারের অর্থবিষয়ক নীতিনির্ধারকরা এডিপি বাস্তবায়নের হার কম হওয়ার মূল কারণগুলো বলা থেকে বিরত থেকে জনগণের সামনে থাকা বিষয়গুলো তুলে ধরেন, যাতে করে মূল বিষয়গুলো আড়াল করা যায়। যেমনÑ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাক্সিক্ষত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যেসব কারণের কথা জানিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতায় সরবরাহকারীদের যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারা, জমি অধিগ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ-প্রশিক্ষণ ও গাড়ি কেনায় কৃচ্ছ্রসাধন, দুর্গম এলাকার প্রকল্পের জন্য শ্রমিক দুষ্প্রাপ্যতা, অর্থবছরের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকল্পের অর্থ ধরে রাখা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘœ ইত্যাদি।
অন্যদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এডিপি বাস্তবায়নে কম হারের প্রধান কারণ আমলারা সরাসরি না বললেও বোঝা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা সংস্কারমূলক কর্মকা-ে জোর দেওয়ায় অর্থ খরচের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা। বাংলাদেশে এডিপি বাস্তবায়নের কম হারের কারণ অনুসন্ধানে যেসব বিষয় প্রকৃত অর্থে সামনে উঠে আসে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ
১. প্রশাসনিক দুর্নীতিসৃষ্ট দুর্নীতির চক্রÑ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রশাসনিক দুর্নীতিই বাংলাদেশে এডিপি বাস্তবায়নের কম হারের প্রধান কারণ, যার প্রভাব পড়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এতে শুরুতেই প্রকল্পের খরচ ও সময় বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রশাসনিক দুর্নীতির প্রভাবে প্রকল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থ অপব্যবহার, ভুল ব্যয় ও মিথ্যা বিলের কারণে প্রকল্পের মূল বাজেটের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি হয়ে যায়। নতুন বছর নতুন করে প্রকল্প তৈরি হয়, আবারও দুর্নীতির সুযোগ সম্প্রসারিত হয়। দিনশেষে সৃষ্টি হয় দুর্ভেদ্য এক চক্র।
২. প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন প্রক্রিয়ার বিলম্বÑ প্রকল্প গ্রহণ থেকে শুরু করে অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। প্রায়ই এই প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। এর কারণ প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপে ঘুষ, কমিশন এবং অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ প্রক্রিয়া। দুর্নীতির ভয় প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
৩. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপÑ বাংলাদেশে প্রকল্প বাছাই ও বাস্তবায়ন থেকে ছোটখাটো সব ধাপেই রাজনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়। এতে করে প্রকল্পের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও খরচ বৃদ্ধি পায়। ফলে সঠিকভাবে ও সময়ে কার্যক্রম পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে নির্বাচনী বছরে উন্নয়ন কাজের প্রয়োজনীয়তা ও অর্থছাড়ে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে থাকে।
৪. অদক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবÑ অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের অভাব থাকে। একই সঙ্গে অনেক প্রকল্প পরিচালকের অভিজ্ঞতার অভাব, ব্যবস্থাপনা অদক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব প্রকল্প বাস্তবায়নকে ধীরগতি করে দেয়।
৫. আর্থিক বরাদ্দ ও অর্থায়নের সমস্যাÑ প্রায়ই বরাদ্দ করা অর্থ সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না, যা প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত করে। এ ছাড়াও অনেক সময়ে অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি থাকায় প্রয়োজনীয় সময়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
৬. যোগ্য জনবল ও প্রযুক্তির অভাবÑ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন। এই দুইয়ের অভাবে প্রকল্প পরিচালনা প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায় এবং নির্ধারিত সময়ে তা বাস্তবায়ন হয় না।
৭. জবাবদিহি না থাকাÑ এডিপি বাস্তবায়নের বেহাল দশার অন্যতম একটি কারণ আগাগোড়া প্রচ- জবাবদিহির ঘাটতি। জবাবদিহি থাকলে বছরের পর বছর একই চিত্র দেখতে হতো না।
বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সমস্যার কারণ ও সমাধান কী, সেটা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই কম-বেশি বলে আসছেন। তারপরও আমাদের একই গান শুনতে হয় বারবার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কোনো হেলদোল দেখা যায় না। কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে এডিপির বাস্তবায়ন চিত্র ভালো করা সম্ভব। যেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ
১. প্রশাসনিক দুর্নীতি রোধÑ প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওয়ায় আনতে হবে। দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের শেষ পর্যন্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
২. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানোÑ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার অপসংস্কৃতি রাজনীতিবিদদের বন্ধ করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমানোর জন্য কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
৩. দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাÑ প্রকল্প গ্রহণ থেকে অনুমোদন পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করার জন্য প্রশাসনিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া অনলাইনে অনুমোদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করে তা আরও সহজ করা যায়।
৪. দক্ষতা উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দক্ষতা বাড়ানোÑ প্রকল্প পরিচালকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। এটি তাদের প্রকল্প পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াবে এবং সময়মতো কাজ শেষ করতে সহায়তা করবে।
৫. আর্থিক ব্যবস্থাপনা সহজতর করাÑ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ সহজে এবং নির্ধারিত সময়ে প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রকল্প পরিচালনা অব্যাহত থাকবে এবং অর্থের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
৬. জনবল ও প্রযুক্তি উন্নয়ন- প্রকল্পে দক্ষ জনবল নিয়োগ এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে কাজের গতি বাড়বে এবং সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
জনগণের প্রত্যাশার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার হরেদরে বৃদ্ধির চেষ্টা না করে পুরো বিষয়টিকে একটি টেকসই ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে যেতে পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চিতভাবেই এর সুফল পাবে।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়