ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২

এ প্লাস নয়, দরকার প্রকৃত শিক্ষা

শহিদুল ইসলাম নিরব

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ১৩ জুলাই ২০২৫

এ প্লাস নয়, দরকার প্রকৃত শিক্ষা

ছবি: সংগৃহীত

এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে অতীতের মতো এ প্লাসের ছড়াছড়ি নেই। তবে এর মানে এই নয় যে খাতা যাচাইয়ে কোনো কঠোরতা এসেছে। বরং বাস্তবতা হলো—বিগত বছরগুলোর মতো এবার ‘গ্রেস মার্ক’ দিয়ে শিক্ষার কৃত্রিম উন্নয়ন দেখানোর চেষ্টা হয়নি। উত্তরপত্রগুলো মোটামুটি সৎভাবে দেখা হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

আমার ধারণা, উত্তরপত্র যদি প্রকৃত মানদণ্ডে যাচাই হতো, তবে পাসের হার এবং এ প্লাসের সংখ্যাটি আরও অনেক কম হতো। আমি নিজ চোখে এমন অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি, যারা একটি পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি বাক্য সঠিকভাবে লিখতে পারে না—তবুও তারা এ প্লাস পেয়ে গেছে।

তবে ফলাফলের বিপর্যয়ের দায় শুধু শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা বা পড়ালেখার প্রতি অনীহার ওপর চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। শিক্ষা ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও সমানভাবে দায়ী।

হঠাৎ করে পাঠ্যসূচি পরিবর্তন, মান বণ্টনে ঘন ঘন পরিবর্তন, শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব—এসব বিষয় শিক্ষার্থীদের জন্য আরও বিভ্রান্তিকর করে তুলেছে শিক্ষা-জগৎকে। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে—‘বিজ্ঞাপনের সংজ্ঞা’ মুখস্থ করিয়ে পাঠ শেষ করে দেওয়া হয়, অথচ সেটি বাস্তবে কিভাবে কাজ করে, তা দেখানোর মতো যন্ত্রপাতিরই অভাব। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব।

এবারের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণিত ও ইংরেজিতে বিপর্যয় সবচেয়ে বেশি। এর কারণ বহুমাত্রিক। একজন ইংরেজি শিক্ষক যদি নিজেই শ্রেণিকক্ষে ঠিকঠাক ইংরেজিতে কথা বলতে না পারেন, তাহলে শিক্ষার্থী কিভাবে শিখবে? আমার অভিজ্ঞতা বলছে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি ইংরেজি শিক্ষক ইংরেজিতে সাবলীল নন। কারণ অনেকেই শুধুমাত্র মুখস্থ করে অনার্স পাস করেছেন, ইংরেজিতে নেই যথার্থ দক্ষতা।

শুধু ইংরেজি নয়, বাংলা সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞানসহ প্রায় সব বিষয়ে একই চিত্র। শিক্ষকেরা নিজেরাও সেই ধারাবাহিক মুখস্থভিত্তিক পদ্ধতির পণ্য। ফলে তারা শিক্ষার্থীদের মৌলিক বোঝাপড়ার সুযোগ দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

তবে পাসের হার এবং এ প্লাস কমার মধ্যে একটা ইতিবাচক দিকও আছে। সরকার বুঝতে শুরু করেছে—কৃত্রিমভাবে পাশের হার বাড়ানোর সংস্কৃতি জাতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। আমরা এমন একটি জাতি গড়তে চাই, যারা চাকরি পাওয়ার যোগ্য হবে, শুধু সার্টিফিকেটধারী নয়। যারা প্রকৃত শিক্ষা লাভ করে, দক্ষতা অর্জন করে সমাজে অবদান রাখতে পারবে।

অবস্থার উন্নতি করতে কিছু  প্রস্তাবনা: পাঠ্যবই ও সিলেবাসে ঘন ঘন পরিবর্তন নয়; দীর্ঘমেয়াদি, সময়োপযোগী ও পরিপক্ব পরিকল্পনা জরুরি। শিক্ষকদের বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষকদের জন্য IELTs বা সমমানের দক্ষতা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষকদের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পর্যাপ্ত সরঞ্জামের নিশ্চয়তা দিতে হবে। মুখস্থনির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্লেষণ ও প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি জাতীয় মানদণ্ড থাকা দরকার, যেখানে প্রান্তিক স্কুলের শিক্ষার্থীরাও সমান সুযোগ পাবে।

শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড—এটা শুধু বাক্যমাত্র নয়। যদি সত্যিই আমরা একটি আত্মনির্ভরশীল, দক্ষ ও মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গড়তে চাই, তাহলে সময় এসেছে শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুখোশহীন ও কার্যকর করে গড়ে তোলার।
 

শহিদুল ইসলাম নিরব

কবি ও সাংবাদিক

×