গারো সম্প্রদায়
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ হল গারো। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এদের অবস্থান। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গারো সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট, ধোবাউরা, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর এবং টাঙ্গাইল জেলায়।
গারোদের আদি বাসভূমি বর্তমান চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল হলেও পরবর্তীতে তারা দেশত্যাগ করে তিব্বতে বসবাস শুরু করেন। এরপর তাদের মূল আবাসস্থল হয়ে উঠে ভারত এবং বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে গারো পাহাড়ে তাদের দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস শুরু হয়।
গারো সম্প্রদায়ের সমাজ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এরা মাতৃতান্ত্রিক। তাদের খাদ্যভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবনযাত্রার চিত্র ভিন্ন হলেও বর্তমানে তারা অনেকাংশে বাঙালিদের মত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।
গারোদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মের নাম সাংসারেক। কিন্তু বর্তমানে এই গারো সম্প্রদায় মূলত ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী এবং তাদের জীবনধারা এই বিশ্বাসের উপর প্রভাবিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গারো সম্প্রদায়ের জন্য মিশনারী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। মিশনারী শিক্ষা, যা মূলত শিক্ষা ও ধর্মের মিশ্রণ।
এই স্কুলগুলোর মাধ্যমে তারা আধুনিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মাতৃভাষার শিক্ষাও পেয়ে থাকে ; যা তাদের সংস্কৃতিকে আরও সুসংহত করে। যদিও এর পেছনে ভিন্ন একটি কারণও রয়েছে। গারো সন্তানদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের জন্য মিশনারী স্কুল ব্যতীত অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই সুযোগ ছিল না।
বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য কোনো ধর্মীয় শিক্ষক/শিক্ষিকা নেই। গারো সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্মীয় শিক্ষকের অভাব একটি গুরুতর সমস্যা। ময়মনসিংহ হালুয়াঘাটের চরবাংগালিয়া, ধোবাউড়া, গাবরাখালি ও টেংরামারি এলাকায় গারো জনগোষ্ঠীর মাঝে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়, কিছু বছর আগেও এই জনগোষ্ঠী সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের পড়তে পাঠালেও, বর্তমানে তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক সুবিধা বাদ দিয়ে নিজেদের সন্তানদেরকে মিশনারী স্কুলে ভর্তি করছে।
যার প্রধান কারণ ধর্মীয় শিক্ষকের অভাব। আর যারা এখনো পড়াশোনা করছে তাদের অভিযোগ যে, নিয়মিত ক্লাস তো নেওয়াই হয় না বরং পরীক্ষার খাতাও দেখা হয় অবহেলার সাথে। গারো জনগোষ্ঠী যখন তাদের সন্তানদের সরকারি স্কুলে পাঠায়, সেখানে অন্য প্রধান দুটি ধর্ম - ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের চর্চা থাকলেও খ্রিষ্ট ধর্ম পাঠদানের জন্য কোন ব্যবস্থা এবং শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়না। ফলশ্রুতিতে সেসকল শিক্ষার্থীরা নিজেদের বঞ্চিত অনুভব করে ও ধর্মের প্রতি বিমুখতা সৃষ্টি হয়। যার প্রেক্ষিতে তাদের পাঠানো হয় মিশনারী স্কুল-কলেজ গুলোতে।
একটি মিশনারী স্কুল সেন্ট মেরিজ পরিদর্শনে জানা যায়, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান থেকেও ছোট ছোট বাচ্চাদের ময়মনসিংহে নিয়ে আসা হয় ধর্মীয় পাঠদানের জন্য। এসকল বাচ্চাদের বয়স মাত্র ৫-৬ বছর, মায়ের আদর যে বয়সে তাদের একান্তই কাম্য সে বয়সে তাদের ঘর ছেড়ে প্রায় ৩৭০ কি.মি পথ পাড়ি দিয়ে এই স্কুলে ভর্তি হতে হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে সন্তান মানুষ করা। এই ছোট্ট ছোট্ট মানবশিশুরা বছরে মাত্র দুইবার বাড়ি যাওয়ার সু্যোগ পায়। এই সুযোগ ও বঞ্চনার মূল কারণ সরকারের সুদৃষ্টির অভাব। এই চিত্রে তারা যে শুধু ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ সুবিধা হারাচ্ছে তা নয়, এরা একের পর এক সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চনার শিখার হচ্ছে। সেই সাথে ভবিষ্যৎ হচ্ছে বাধাগ্রস্থ। তাই গারো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষাগত মান উন্নয়নের জন্য সরকারের একাগ্রতা কাম্য।
দেবযানী কুর্চি কাঁকন, এইচএসসির ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী, বিজ্ঞান বিভাগ, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ, ঢাকা।
গৌতম/শহিদ