ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

প্রবাসে উদ্ভাসিত বরেণ্য সৈয়দ

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২১:০০, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রবাসে উদ্ভাসিত বরেণ্য সৈয়দ

সুকুমার রায়

প্রবাসীদের জীবনে প্রভাব ফেলেছেন এমন লেখক কম নয়। বাংলা বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, তাঁদের ধারাবাহিকতায় যুক্ত আছেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ থেকে শহীদ কাদরী কিংবা সদ্য প্রয়াত গোলাম মুরশিদ। একা একজন নীরদ সি চৌধুরী প্রবাসকে ধরে রেখেছিলেন। আজ আমরা এটা মানতে বাধ্য যে, দূর দেশের সঙ্গে জন্মভূমির পার্থক্য সময়ের হলেও স্থানিক দূরত্ব এখন কোনো ব্যাপার না।

এই ধারাবাহিকতায় আমার বিবেচনায় সৈয়দ মুজতবা আলী শীর্ষে। তিনি শুধু প্রবাসের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেই চুপ ছিলেন না, তাঁর লেখার চরিত্রগুলো আমাদের অনেক দেশ বা তার চরিত্র চিনিয়েছে। একা আবদুর রহমান আমাদের সবার পরিচিত, যে বলেছিল ইনহাসতে ওয়াতানাম- এই তো আমার জন্মভূমি।
 আমরা জীবনে যতগুলো মুড়ি চাবাই যেন ততগুলো ভাষা চিবিয়ে খেয়েছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। মুজতবা আলী সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র।

এখান থেকে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ পনেরোটি ভাষাশিক্ষা লাভ করে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডি.ফিল লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩৪-১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মিসরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তাঁর মতো বিদ্বান ও ভাষাবিদ এখন বিরল। আমাদের মনে রাখতে হবে প্রবাস জীবনের সঙ্গে সুপরিচিত এই লেখক কোনো রাজনীতি বা তেমন বিষয় টেনে  আনতেন না।

অথচ সব লেখাই ছিল সমাজ আর জীবনের দর্পণ। এই আয়নায় এখনো আমরা মুখ রাখতে পারি। এখনো দেশে-বিদেশের লেখক সৈয়দ মুজতবা  আমাদের পথ দেখান। সমাজে যখন রবীন্দ্রনাথ নজরুল নিয়ে নানা প্রশ্ন তখনো তিনি প্রাসঙ্গিক। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছিলেন কান্তি ঘোষ এবং কাজী নজরুল ইসলাম। সৈয়দ মুজতবা লিখলেন, কাজীর অনুবাদ সকল কাজের কাজী। এটাই সৈয়দ মুজতবার কলমের গুণ। একটানে এক কথায় সবকিছু বলতে পারা। বিশ্বাস করি, তিনি আমাদের প্রবাস জীবন ও মূল ধারার সেই পথিকৃৎ যাঁকে ছাড়া বাঙালি অচল।
তাঁকে নিয়ে দুই কলম না লিখলে যে পাপ হবে। জীবনে যে ক’জন মানুষ আমাকে পথ দেখান তিনি তাঁদের একজন। কেন ভালোবাসি? এই সেই মানুষ যিনি জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথ এসেছেন শুনে দেখা করতে গিয়েছিলেন হোটেলে। রিসেপশান বসিয়ে রাখলে কবিগুরু ডেকে পাঠান শিষ্যকে।

রুমে গিয়ে দেখেন ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ কবির। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর চোখ মেলতে না পারা রবীন্দ্রনাথ মুজতবা আলীকে বলেছিলেন, আমি গেলাম। তুমি কিন্তু মুরগির ঝোল আর ভাত না খেয়ে যেও না। অসাধারণ রান্না এদের। মুজতবা আলী লিখছেন, এই আমার গুরু। সক্রেটিস যেন মৃত্যুর আগে মুরগির দাম চুকানোর কথা বলতে ভোলেননি, আমার গুরুদেবও আমাকে মুরগি না খাইয়ে ঘুমাতে যাননি।
তাঁর লেখাতেই পড়েছি, কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় তাঁকে ডাবল ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। অন্য সব অধ্যাপকরা বলাবলি করছিলেন, কিসের জোরে পেলে? আমাদের সার্টিফিকেট কত নামজাদা ইউনির্ভাসিটির আর কত সব জাঁদরেল ভিসিদের সহি করা সার্টিফিকেট। আর তোমার? মুচকি হেসে বলেছিলেন, আমার গুরুদেব তো স্কুলেই যাননি। আর তিনি তো নোবেলজয়ী কবি। তোমাদের কেউ আছে এমন?

হালকা রসিকতায় পটু লেখায় লিখেছিলেন, চুল না কাটানোয় গিন্নী ডাকাতের মতো লাগছে বলতে বলতে ক্লান্ত করে তোলা বাবু গেলেন চুল কাটাতে। চুল কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই গিন্নীর আর্তনাদ  একি! এতো পুরোই চোরের মতো লাগছে। এই আমাদের রসময় সৈয়দের পো। যাঁর আয়ত্তে ছিলো ভাষার পাহাড়। যিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িকতা আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা করে গেছেন। এমন রসিক ক’জন আছেন?

যিনি লিখতে পারেন বন্ধু নাকি জুতার কালি কিনতে গিয়ে বারবার বলছে, আরও ঘন কালো কালি নাই? শেষে বিরক্ত হয়ে বলেছিল আরে মশাই আমার এই বন্ধুটির গায়ের মতো রং দেখান না কেন?
অসাধারণ গৌরকান্তি ছিলেন তিনি। বালক বেলায় রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে উত্তর পেয়ে সেই যে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন, সেখানেই কেটে গেছে তাঁর জীবন। তাঁর সাধনার বাঙালি সমাজ আজ পুস্তক বির্বজিত।
তাঁর ‘পঞ্চতন্ত্র’ গ্রন্থটিতে দারুণ একটি গল্প আছে। অন্য দেশের এক বণিক উপমহাদেশের একটি তোতা নিয়ে গিয়েছিলেন পুষবেন বলে? তোতাটি ছিল তার জান। সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাটিকে কথা বলা ও শেখানো হলো? ঘরে ঢুকলেই তোতা বণিককে সালাম দিতো?। তো বাণিজ্যে যাবার জন্য ফের প্রস্তুত বণিক সবার কাছে জানতে চাইলেন কার জন্য কি আনতে হবে।

সবশেষে তোতার ঘরে ঢুকতেই তোতাটি বলল, জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন, তবু আমি তো বন্দি। সোনার খাঁচার চাইতে সবুজ মাঠ নীলাকাশই চাই আমার হুজুর। বাণিজ্যকালে তোতাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা হবে আপনার? আমাকে সেখান থেকেই ধরে এনেছিলেন আপনি। তাদের কাউকে জিজ্ঞেস করবেন আমার মুক্তির পথ কি?
কয়েক মাস পর বাণিজ্য শেষে বাড়ি ফিরলেন বণিক। সবাইকে উপহার বুঝিয়ে দিলেও তোতার ঘরে আর ঢোকেন না। শেষমেশ একদিন ঢুকতেই তোতাটি সালাম দিয়ে বললো, হুজুর একদিনও এলেন না এ ঘরে? কিছু বললেনও না। উল্টো দিকে ফিরে বলল, তোমার সগোত্রীয় তোতাদের সঙ্গে দেখা হলে মুক্তির পথ কি জানতে চেয়েছিলাম? লাভ তো হলোই না, বরং তোমার বন্দিদশা শুনে একটি তোতা সেখানেই মরে পড়ে গেল।

বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝুপ করে শব্দ। চকিতে পেছন ফিরে বণিক দেখলেন, তার তোতাটি ও মরে পড়ে আছে খাঁচার ভেতর। কী আর করা, খাঁচা খুলে তোতাটিকে ফেলে দেওয়ার জন্য বের করে আনতেই সে উড়ে যেতে যেতে বলল, হুজুর ঐ তোতাটি মরেনি? সে আমার মুক্তির পথ বাতলে দিয়ে গেছে। বলতে বলতে শূন্যে উড়াল দিল মুক্ত তোতা। 
কী অসাধারণ এক গল্প।
শুভ জন্মদিন সৈয়দ মুজতবা আলী।

[email protected]

×