ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ ও আরাধনা

ড. সনজিত পাল

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২৪

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ ও আরাধনা

বছর ঘুরে আবার এসেছে জন্মাষ্টমী তিথি

বছর ঘুরে আবার এসেছে জন্মাষ্টমী তিথি। বিশ্বব্যাপী মহামারির অবসান হলেও অর্থনৈতিক হাহাকার, যুদ্ধের ফলে অজস্র প্রাণহানি ও বৈশি^ক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত পৃথিবীর বুকে পরমেশ^র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি বিশ^বাসীর জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে– এটাই প্রার্থনা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমীতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে জানাই কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা।
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত সৃষ্টির উৎস এবং তাঁকে বলা হয় সব কিছুর নিমিত্ত কারণ। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘যেহেতু সব কিছু আমার থেকে সৃষ্টি হয়েছে, তাই আমিই সব কিছুর আদি উৎস। সব কিছুই আমার অধীন। আমার উপরে কেউ নেই।’ সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র এক বাক্যে স্বীকার করে যে, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ব্রহ্মা, শিব, আদি সমস্ত দেব-দেবীর উৎস। অথর্ব বেদে (গোপালাতাপনী উপনিষদ ১/১৪) বলা হয়েছে, ‘ব্রহ্মা, যিনি পূর্বকালে বৈদিক জ্ঞান প্রদান করেন, তিনি সেই জ্ঞান সৃষ্টির আদিতে শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে প্রাপ্ত হন।’

নারায়ণ উপনিষদে (১) বলা হয়েছে, ‘অথ পুরুষো হ বৈ নারায়ণোহ কাময়ত প্রজা: সৃজয়েতি’- ‘তারপর পরমেশ^র ভগবান নারায়ণ প্রাণী সৃষ্টির ইচ্ছা করেন।’ উপনিষদে আরও বলা হয়েছে ‘নারায়ণ হতে ব্রহ্মার জন্ম হয়, নারায়ণ হতে প্রজাপতিদের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে ইন্দ্রের জন্ম হয়, নারায়ণ হতে অষ্টবসুর জন্ম হয়, নারায়ণ হতে একাদশ রুদ্রের জন্ম হয় এবং নারায়ণ থেকে দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম হয়।’ এই নারায়ণ হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের স্বাংশ-প্রকাশ।

বেদে (নারায়ণ উপনিষদ ৪) বলা হয়েছে ‘ব্রহ্মণ্যো দেবকীপুত্রঃ’- ‘দেবকীপুত্র শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরমেশ^র ভগবান।’ সেখানে (মহা উপনিষদ ১) আরও বলা হয়েছে - ‘সৃষ্টির আদিতে কেবল পরম পুরুষ নারায়ণ ছিলেন। ব্রহ্মা ছিল না, শিব ছিল না, চন্দ্র ছিল না, আকাশ, নক্ষত্র ছিল না এবং সূর্য ছিল না।’ মহা উপনিষদে আরও বলা হয়েছে যে, শিবের জন্ম হয় পরমেশ^র ভগবানের ভ্রƒযুগলের মধ্য থেকে। বেদে বলা হয়েছে, ‘ব্রহ্মা ও শিবের যিনি সৃষ্টিকর্তা, সেই পরমেশ^র ভগবানই হচ্ছেন সকলের আরাধ্য।’

মোক্ষধর্মে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘প্রজাপতিগণ, রুদ্র ও অন্য সকলকে আমি সৃষ্টি করেছি, যদিও তাঁরা তা জানেন না। কারণ, তারা আমার মায়াশক্তির দ্বারা বিমোহিত।’ বরাহ পুরাণে বলা হয়েছে, ‘নারায়ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান আর তাঁর থেকে ব্রহ্মার জন্ম হয়, তাঁর থেকে শিবের জন্ম হয়।’ 
কলি যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনার উপায় সম্পর্কে তিনি শ্রীমদ্ভগবদগীতায় সখা অর্জুনকে বুদ্ধিযোগের  ব্যাখ্যা করেছেন।

বুদ্ধিযোগের অর্থ হচ্ছে কৃষ্ণভাবনাময় কর্ম। সেটিই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তি। বুদ্ধির অর্থ হচ্ছে বোধশক্তি এবং যোগের  অর্থ হচ্ছে অতীন্দ্রিয় কার্যকলাপ অথবা যোগরূঢ়। কেউ যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আলয় ভগবৎ ধামে ফিরে যেতে চান এবং সেই উদ্দেশ্যে কৃষ্ণভাবনাময় ভগবৎ সেবায় সম্যকভাবে নিযুক্ত হন, তখন তাঁর সেই কার্যকলাপকে বলা হয় বুদ্ধিযোগ। পক্ষান্তরে বুদ্ধিযোগ হচ্ছে সেই পন্থা, যার ফলে জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। 
কেউ যখন মানব জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হওয়া সত্ত্বেও কর্মফল ভোগের প্রতি আসক্ত হয়ে থাকে, তখন সেই স্তরে সাধিত কর্মকে বলা হয় কর্মযোগ। কেউ যখন জানতে পারে যে, পরম লক্ষ্য হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীকৃষ্ণকে জানবার জন্য মনোধর্ম প্রসূত জ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করে, তাকে বলা হয় জ্ঞানযোগ।

কেউ যখন পরম লক্ষ্য সম্বন্ধে অবগত হয়ে ভক্তিসহকারে শ্রীকৃষ্ণের সেবা করেন, তখন তাকে বলা হয় ভক্তিযোগ বা বুদ্ধিযোগ এবং সেটিই হচ্ছে যোগের পরম পূর্ণতা। যোগের এই পূর্ণতাই হচ্ছে জীবনের সর্বোচ্চ সিদ্ধির স্তর। আমাদের উচিত, সদ্গুরুর আশ্রয়প্রাপ্ত হয়ে ভগবানের আরাধনা করা। তাহলে পারমার্থিক উন্নতি সাধনের জন্য যথার্থ বুদ্ধি যদি না থাকে, তা হলে শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের অন্তরস্তল থেকে তাঁকে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করেন, যার ফলে তিনি অনায়াসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে যেতে পারেন।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই কৃপা লাভ করার একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে, কৃষ্ণভাবনাময় হয়ে প্রীতি ও ভক্তিসহকারে সর্বক্ষণ-সর্বপ্রকারে ভগবানের সেবা করা। ভক্ত যদি আত্ম-উপলব্ধির বিকাশ সাধনে যথার্থ বুদ্ধিমান না হন, কিন্তু ভক্তিযোগ সাধনে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহী হন, তা হলে ভগবান তাঁকে সুযোগ প্রদান করেন। যার ফলে তিনি ক্রমশ উন্নতি সাধন করনে এবং অবশেষে তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারেন।
ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করার মাধ্যমেই পরম সত্য শ্রীকৃষ্ণকে পরিতুষ্ট করা যায় এবং তাঁর অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে তিনি তাঁর শুদ্ধ ভক্তের হৃদয়ে নিজেকে প্রকাশিত করেন। শ্রীকৃষ্ণ সর্বদাই তাঁর শুদ্ধ ভক্তের হৃদয়ে বিরাজমান এবং সূর্যসম শ্রীকৃষ্ণের সান্নিধ্যের ফলে অজ্ঞানতার সমস্ত অন্ধকার তৎক্ষণাৎ বিদূরিত  হয়।

শুদ্ধ ভক্তের প্রতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এটি একটি বিশেষ কৃপা। লাখ লাখ জন্ম-জন্মান্তরে বৈষয়িক সংসর্গের কলুষতার ফলে জড়বাদের ধূলির দ্বারা আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু আমরা যখন ভক্তিযোগে ভগবৎ সেবায় যুক্ত হয়ে নিরন্তর হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে থাকি, তখন অতি শীঘ্রই হৃদয়ের সমস্ত আবর্জনা বিদূরিত হয় এবং আমরা শুদ্ধ জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নতি লাভ করি।

ভগবদ্গীতা অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমরা সর্বতোভাবে ভগবানের চরণে আত্মসমর্পণ করে শুদ্ধ ভক্তিযোগে তাঁর সেবায় নিযুক্ত হতে পারি। 
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান এবং তাঁর ধ্যানে মগ্ন থেকে আমরা তাঁর সঙ্গে আমাদের অপ্রাকৃত সম্পর্কের আনন্দ উপলব্ধি করতে পারি। তিনিই হচ্ছেন শাশ^ত অস্তিত্ব। তিনি সব রকম দৈহিক প্রয়োজন, জন্ম ও মৃত্যু থেকে মুক্ত।

সে কথা ভগবদ্গীতায় শুধু যে অর্জুনই বলেছেন, তা নয়, সমস্ত বৈদিক সাহিত্য, পুরাণ ও ইতিহাস যুগ-যুগান্তর ধরে ঘোষণা করে আসছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই তার পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, ‘যদিও আমি অজ, তবুও এই পৃথিবীতে আমি ধর্ম সংস্থাপন করবার জন্য অবতরণ করি।’ তিনি পরম উৎস; তাঁর কোনো কারণ নেই, কেননা তিনিই হচ্ছেন সর্ব কারণের আদি কারণ এবং তাঁর থেকেই সব কিছুর প্রকাশ হয়েছে। 
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে কারণে বাংলাদেশের কোথাও কোথাও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুট করা হয়েছে, মন্দিরের প্রতিমা ভেঙে অগ্নি সংযোগ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি কারও কাম্য হতে পারে না। আমরা সব ধর্মের মানুষ এই দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে বসবাস করতে চাই। বাংলাদেশ আমাদের সকলের। এই দেশে সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় আচরণ ও উৎসব পালন করার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হবেÑ এমন প্রত্যাশা আমাদের। 
আজ জন্মাষ্টমীর মহাপুণ্যময় তিথিতে লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণপদ্মে আমাদের এই হোক প্রার্থনা, আমরা যেন নিজেদের জড় কামনা-বাসনা ত্যাগ করে ভগবানের প্রতি প্রীতিময় সেবায় যুক্ত হতে পারি। ঐকান্তিক সেবার দ্বারা ভগবানকে তুষ্ট করে নিজেদের অন্তরের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে পারি। 
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ, প্রাক্তন সভাপতি, শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংঘ, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়

×