ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শতাব্দী পেরিয়ে জ্ঞানের আলো আজও ছড়াচ্ছে যে লাইব্রেরি

হৃদয় হোসাইন,কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার,পাবনা

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২১ মে ২০২৫; আপডেট: ১০:১৮, ২১ মে ২০২৫

শতাব্দী পেরিয়ে জ্ঞানের আলো আজও ছড়াচ্ছে যে লাইব্রেরি

ছবি: জনকন্ঠ

দেশী বিদেশি লেখকের হাজারো বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে পাবনা শহরে অবস্থিত অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি। কালের সাক্ষী শহরের কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী পুরাতন স্থাপনার মধ্যে এটি অন্যতম। পাবনা শহরের আব্দুল হামিদ রোডে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি।

বরদা গোবিন্দের দত্তক পুত্র অন্নদা গোবিন্দ চৌধুরী নিজের নামানুসারে পাবনা শহরে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে কালের ইতিহাসে এক অক্ষয় সেতু গেঁথে দেন।

চার তলা ভবনের এই লাইব্রেরিতে দুইশত বছরের পুরাতন বই আছে। মতান্তরে এ কথাও জানা যায় যে,জ্ঞানদা গোবিন্দ পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে ১৮৮৯ সালে লাইব্রেরি নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেন। তিনি গ্রন্থাগারটির পরিসর বড় করেন। ১৮৯০ সালে ভাইসরয় লর্ড ল্যান্স ডাইনের (১৮৮৮-৯৪) শাসনামলে জ্ঞানের ভুবন এই অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির দ্বারোদ্ঘাটনের কথা আজও অনেকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়।

এ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার আগে পাবনায় আরও কয়েকটি গ্রন্থাগার ছিল। তবে এ গ্রন্থাগারের মহিমা আজও প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। এ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার সময়ে পৌরসভার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ১৩ সের চাল যখন এক টাকায় পাওয়া যেত,তখন সেই ১৮৯০ সালের পাবনায় এই অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি ও অস্ট্রেলীয় মিশনারি গির্জা গড়ে ওঠে। সে সময়কার রোকনপুর পরগনায় (বর্তমানে গোপালপুর মৌজা) ১৩ শতাংশ জমির ওপর দুটি কক্ষের একটিতে লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়। পাশে ছিল একটি টিনের ঘর। জানা যায়, গ্রন্থাগারটির প্রথম সম্পাদক সীতানাথ অধিকারী ছিলেন এর দখলদার। তখন এ জমি ছিল নিষ্কর। উল্লেখ্য, ১৯৩৪ থেকে খাসমহলে (তাড়াশ বিল্ডিং) এক টাকা খাজনা দিতে হতো। লাইব্রেরির জন্মলগ্নে পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর এফ বিজ পদাধিকার বলে এর সভাপতি ছিলেন। ১৯২৮ সালের ৮ জুলাই এক অধিবেশনে ‘অল বেঙ্গল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন’-এর মেম্বার শ্রেণিভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরিতেও এই সমিতির শাখা খোলা হয়। তখন লাইব্রেরির সদস্য বাড়ানো ও পাবনার শিক্ষিত জনগণের কাছ থেকে সাহায্যপ্রাপ্তির আশায় এক হাজার কপি আবেদন মুদ্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

তখনও পাবনায় বিদ্যুৎ আসেনি। পাঠকরা লাইব্রেরির ১৩ টাকা আট আনা মূল্যের পেট্রোম্যাক্স লাইটে পড়াশোনা করত। ১০০ টাকা ব্যয়ে লাইব্রেরিতে বিদ্যুৎ আসে ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে। বিদ্যুৎব্যবস্থা লাইব্রেরির কর্মোদ্যম বাড়িয়ে দেয়। ১৯৩৭ সালে লাইব্রেরির সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ রায় ও পূর্ণচন্দ্র রায় দায়িত্ব নেন সাহিত্য সম্মেলনের। ১৯৩৮ থেকে ১৫ দিন অন্তর সাহিত্য সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৩৯ সালে লাইব্রেরিতে আসেন বাংলার দুই মন্ত্রী শ্রীশচন্দ্র নন্দী (কর্মজীবন মন্ত্রিত্ব দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীকালে তিনি কলিকাতা বঙ্গীয় পরিষদের সভাপতি হন) ও নলিনীরঞ্জন সরকার। ওই একই বছরে অনুষ্ঠিত হয় ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। তখন ৬৪ টাকা ১০ আনা পাঁচ পাই ব্যয়ের এ অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে আসেন সাহিত্যিক পরিমল কুমার গোস্বামী ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

১৯৪২ সালের ১ আগস্ট থেকে অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি, রবীন্দ্র পরিষদ, পাবনা সাহিত্য চক্র ও পূর্ণিমা সম্মেলনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টাউন হলে সপ্তাহব্যাপী প্রথম রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপিত হয়। অনুষ্ঠানমালায় আটটি বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ রচিত হয়। জমিদার বংশের অনেকে ছিলেন কবি-সাহিত্যিক। তারা গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য বইপত্র দান করেন। পাশাপাশি আরও অনেক বিদ্যানুরাগী গ্রন্থাগারে বইপুস্তক দান করেন। শুরুতে কিছু বাংলা, সংস্কৃতি ও ফারসি কেতাব নিয়ে শুরু হয় এর পথপরিক্রমা। আরও স্থান পায় রাজা রামমোহন, অক্ষয় কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালী প্রসন্ন, মেহেরুল্লাহ সিংহ, গিরিশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রঙ্গলাল সেন, মধুসূদন দত্ত, হেমনবীন চন্দ্র, বিহারীলাল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ সেন, অক্ষয় কুমার বড়াল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, স্বর্ণকুমারী দেবী, কামিনী রায়, মান কুমারী বসু, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শেখ ফজলল করিম ,অমৃতলাল বসু, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ক্ষীরোদা প্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রমুখের রচনাসম্ভার। কালক্রমে শত লেখকের হাজারো বইয়ে লাইব্রেরিটি সমৃদ্ধ হয়।

উপযুক্ত পরিবেশ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের পাশাপাশি যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অনেক নথিপত্র। তাই ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রক্ষা করতে স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান স্যামসন এইচ চৌধুরীকে অনুরোধ জানানো হয়। স্কয়ার কর্তৃপক্ষ পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চার বছর ধরে ভৌতগত অবকাঠামোর নির্মাণকাজটি সম্পন্ন করে। ফলে দেশসেরা বেসরকারি লাইব্রেরির তকমা পায়।

 ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিসহ প্রায় প্রতিদিন দেশী-বিদেশি পাঠক দর্শনার্থী ভিড় করেন এই লাইব্রেরীতে। লাইব্রেরিটির বর্তমান পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু।

মুমু

×