
ছবি: জনকন্ঠ
চট্টগ্রামের বায়েজীদ রোডের রৌফাবাদ এলাকায় প্রতিদিন একটি দৃশ্য পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ে। দুই পা নেই, তবুও তিনি চলেন—দুই হাতের ওপর ভর করে। মুখে হাসি, চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। শারীরিক অক্ষমতা নয়, তার পরিচয়—অপরাজেয় মনোবল। তার নাম বেলাল উদ্দিন।
১৯৯৩ সালের কথা। বয়স তখন মাত্র ১৩। বন্ধুদের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরতে গিয়েছিলেন। আনন্দময় সেই দিনটি দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায়। সে দুর্ঘটনায় চিরতরে হারান দুই পা। এরপরের জীবন আর দশজনের মতো স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু থেমেও থাকেননি।
বেলাল উদ্দিন এখন দুই হাতে ভর করেই চলেন। জীবনকে থামতে দেননি। বেছে নিয়েছেন সম্মানের পথ। ভিক্ষাবৃত্তির বদলে জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন একটি ছোট্ট অস্থায়ী দোকান দিয়ে, যেখানে বিক্রি করেন গুঁড়া হলুদ ও মরিচ। বগুড়ার খাঁটি পণ্যের পাশাপাশি তার সবচেয়ে বড় সম্পদ—তার আত্মবিশ্বাস আর লড়াকু মানসিকতা।
২০০০ সালে বাবার মৃত্যু তাকে করে তোলে পুরোপুরি একা। বর্তমানে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তার পাঁচ সদস্যের সংসার। নিজে চলাফেরা করতে পারেন না, তবুও সংসারের সব দায়িত্ব তার কাঁধেই। একসময় পান-সিগারেট বিক্রি, সবজি ব্যবসা এবং মেকানিক হিসেবে কাজ করেছেন। চোখের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন সেই পেশা আর সম্ভব নয়, তাই চালিয়ে যাচ্ছেন মসলা বিক্রির ছোট্ট দোকান।
তার প্রতিবেশীরা বলেন, “বেলাল ভাই কোনোদিন কারও ওপর নির্ভর করেননি। তার ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।”
একজন বৃদ্ধা বাসিন্দার মন্তব্য, “শরীরের অর্ধেক নেই, কিন্তু মনটা ওনার আস্ত। আমরা অনেক সময় সম্পূর্ণ শরীর নিয়েও যে সাহস পাই না, বেলাল ভাই সেটাই আমাদের দেখান।”
বেলাল উদ্দিন বলেন, “ভিক্ষা করলে এক বেলা খাওয়া যায়, পরের বেলার জন্য লড়াই করতে হয় না। কিন্তু কাজ করলে সম্মান থাকে, মন শান্ত থাকে।”
তিনি বিশ্বাস করেন, “আত্মবিশ্বাস আর ইচ্ছাশক্তি থাকলে ভাগ্য বদলানো সম্ভব।”
তার জীবন শুধু একটি সংগ্রামের গল্প নয়, এটি একটি বার্তা। বার্তা এই সমাজের প্রতিটি মানুষকে, যারা কোনো এক সময়ে জীবনের কাছে হেরে যেতে বসেছে। বেলাল উদ্দিন দেখিয়ে দিয়েছেন—হার মানার আগে অন্তত একবার লড়াই করে দেখা উচিত।
সরকার ও সমাজ যদি এমন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, যদি এমন উদ্যোমীদের সহযোগিতা করে, তাহলে সমাজে আর কোনো প্রতিবন্ধকতাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। একজন বেলাল নয়—তৈরি হবে হাজারো বেলাল, যারা নিজেই হবে নিজেদের অনুপ্রেরণা।
মুমু