
ছবি: জনকন্ঠ
আলু ধুয়ে পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে পাতলা গোল আকারে কাটা, সেদ্ধ করা, রোদে শুকানো এবং শেষে গরম তেলে মচমচে করে ভেজে চিপস বানানো—এই পুরো প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌরসভার শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের শত শত মানুষ। কেউ সকাল বেলায় বসে আলু পাতলা করে কাটছেন, কেউ সেদ্ধ করে নিচ্ছেন, আবার কেউ শুকানোর জন্য পাটিতে রোদে সাজিয়ে দিচ্ছেন গোলাকার সেদ্ধ আলুগুলো।
এইভাবেই আলু থেকে তৈরি হয় সুস্বাদু চিপস, যা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এই গ্রামের বহু পরিবার। চিপস উৎপাদন ও বিক্রিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতি। প্রায় ৪০০টি পরিবার এখন এ পেশার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, যারা কেবল নিজেদের জীবিকা নির্বাহই করছেন না, বরং স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন এই কাজের মাধ্যমে।
এখন শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামটির পরিচিতি ‘আলুর চিপসের গ্রাম’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে দূরদূরান্তে। তবে কবে থেকে এই পেশার শুরু, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না। অনেকেই মনে করেন, তাদের পূর্বপুরুষরাও এই কাজ করতেন—অর্থাৎ এটি প্রজন্ম ধরে চলে আসা পেশা।
শ্রম, কৌশল ও একনিষ্ঠতায় গড়া এই চিপস উৎপাদন এখন শুধু একটি পেশা নয়; এটি হয়ে উঠেছে গ্রামের অর্থনৈতিক সংস্কৃতির এক অনন্য প্রতীক।
প্রতি বছর মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত আলুর চিপস তৈরিতে মুখর থাকে এই এলাকা। এই সময়টায় গ্রামের শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-যুবতী, এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও ব্যস্ত থাকেন এই কার্যক্রমে। এককথায়, পুরো গ্রাম যেন পরিণত হয় এক বিশাল কর্মশালায়, যেখানে প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকেন চিপস তৈরির কাজে।
এই মৌসুমই তাদের জীবিকার প্রধান সময়। বছরের অন্যান্য সময় তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিরব হলেও এই কয়েক মাসের আয় দিয়েই চলে সারা বছরের সংসার খরচ। ফলে এই পেশা শুধু একটি মৌসুমি উদ্যোগ নয়, বরং তাদের অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার মূল ভিত্তি।
আলু দিয়ে হাতে তৈরি চিপস বা স্থানীয় ভাষায় ‘পাপড়’-এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। স্বাদ ও গুণগত মানের কারণে স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে এসব চিপস রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও সরবরাহ করা হয়। এর ফলে শুধু গ্রামবাসীর আয়-রোজগারই বৃদ্ধি পায়নি, বরং তাদের জীবনে এসেছে স্থিতিশীলতা ও আত্মবিশ্বাস।
এইভাবেই গ্রামটির প্রতিটি ঘর আজ যেন এক একটি ক্ষুদ্র শিল্পের কেন্দ্র, যেখানে ঘাম, সময় আর শ্রম মিলিয়ে তৈরি হয় দেশের নানা প্রান্তে পরিচিত সুস্বাদু আলুর চিপস।
সরেজমিনে শ্রীকৃষ্টপুর সহ পার্শ্ববর্তী গ্রাম ভদ্রকালি, কেশবপুর, চুকাইবাড়ি চকরঘুনাথ, গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে কেউ আলু সেদ্ধ করছেন, আবার কেউ সেদ্ধ আলু ঝুরি-ঝুরি করে গোলাকার কাটছেন। এরপর কাটা আলুগুলো তুলসীগঙ্গা নদীর পাড়, বাঁধ, রাস্তা, পুকুরপাড়ে রোদে শুকাচ্ছেন। কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, তাদের গ্রামে ৪০০ পরিবার বসবাস করে। এর মধ্যে ১০-১২টি পরিবার বাদে সবাই আলুর চিপস তৈরি করে। মৌসুমি এ ব্যবসার আয়ে সারা বছর সংসার চলে। প্রতিদিন দেড় থেকে ২ হাজার মণ আলু সেদ্ধ করা হয়। এই চিপস তৈরি করতে একটু পরিশ্রম হয়। যেসব ব্যবসায়ীর পুঁজি বেশি, তারা বেশি করে আলু কিনে চিপস তৈরি করে সংরক্ষণ করেন। তারাই বেশি লাভ করেন। তারা আরও জানান, আলুর চিপস তৈরির জন্য এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আলু কিনতে হয়। সরকার যদি ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্পসুদে ঋণ দিত, তাহলে তারা উপকৃত হতেন।
শ্রীকৃষ্টপুরের গ্রামের মোঃ বাবলু মন্ডল বলেন, ক্যাডিনাল জাতের আলু চিপসের কাজে ব্যবহার করা হয়। অন্য জাতের আলু দিয়ে চিপস তৈরি হলেও তেমন স্বাদ মেলে না ও ক্রেতাদের চাহিদাও কম থাকে। বাজার থেকে প্রতি মণ ক্যাডিনাল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কেনা হয়। সেই আলুগুলো সেদ্ধ করার পর গোলাকার করে কেটে রোদে শুকিয়ে চিপস তৈরি করা হয়। পাঁচ মণ ক্যাডিনাল আলুতে এক মণ চিপস হয়। তিনি আরও বলেন, আজ থেকে ৫০ বছর আগে এই আলুর চিপস ব্যবসা প্রথমে নিয়ে আসছে আমার বাবা মিরাজ মন্ডল। তারপর থেকে আমি ধরে রেখেছি। আমাদের দেখা দেখি সারাপাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মহাজনরা এসে আলুর চিপস নিয়ে যান। আবার তারা নিজেরাও ঢাকা, রাজশাহী, ময়মনসিং, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আলুর চিপস সরবরাহ করেন। আমরা বাবা দাদার আমল থেকে এ ব্যবসা করে পরিবারের সচ্ছলতাও এসেছে। ছেলেমেয়ে স্কুলে লেখাপড়া করছে। আবার বাড়িঘরেরও উন্নতি হয়েছে।
এমনই একজন মোজাম্মেল সরদার তিনি বলেন, ১৩০ মণ আলু কিনে চিপস তৈরি করেছি। এক মণ শুকনো চিপস তৈরি করতে ২ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সময় লাগে দুই দিন। আর এক মণ চিপস বাজারে পাইকারি বিক্রি হয় ৪ হাজার থেকে ৫হাজার ৫শত টাকায়। গত বছর ১০হাজার টাকা পর্য়ন্তও বিক্রি হয়েছে।
একই গ্রামের তিন কন্যা সন্তানের জননী নূর জাহান বেগম বলেন, চিপস ব্যবসায়ীরা আমাদের আলু কিনে দেয়। আগের দিন সিদ্ধ করে পরের দিন পাতলা ভাবে গোলাকার করে আলু কাটে রোদে পাটিতে শুকাতে দিতে দেয়। শুকিয়ে গেলে তা প্যাকেট জাত করে পায়কারদের পৌঁছে দিতে হয়। এতে তারা যে অর্থ দেয় আমাদের সংসার ভালোই চলে। দিনে ৩ থেকে ৪ মণ আলু সিদ্ধ করে শুকানো যায়। আলুর চিপস বানিয়ে আমি সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজ জমিতে বাড়ি তৈরিও করেছি। আমাদেরকে সরকার যদি এই ব্যবসার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দেয় তাহলে আমরা আলু আরও কিনতে পারব। এই শিল্পটাকে আরও এগিয়ে নেওয়া যাবে। সাবলম্বী হয়ে আমাদেরও সচ্ছলতা ফিরে আসবে। অনেক পরিবারে মহিলারা বসে থাকে । কিন্তু এই গ্রামের প্রায় সব মহিলা সংসারের পাশাপাশি চিপস তৈরিতে সময় দেয় এতে স্বাবলম্বীও হওয়া যায়।
চিপস ব্যবসায়ী মোঃ রফিক হোসেন বলেন, আমি প্রতি বছরের ন্যায় ছোট ছোট চিপস ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চিপস কিনে থাকি। এই চিপস গুলো আগামী নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিক্রি করি। এবার আমি প্রায় ৬ লক্ষ টাকার চিপস ক্রয় করেছি।
আক্কেলপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইমরান হোসেন বলেন, শ্রীকৃষ্টপুরের গ্রামের কৃষকরা আলু প্রক্রিয়া জাত করণের একটি শিল্প গড়ে তুলেছেন। সামনে এ অঞ্চলে বড় একটি সম্ভাবনার দার খুলবে বলে আশা করছি। আলুর বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে আলুচাষিরাও উৎপাদিত আলুর ন্যায্যমূল্য পাবেন। তিনিও আরও বলেন, আমরা তাদেরকে সবসময় পরামর্শ দিচ্ছি তারা যেন স্বাস্থ্যকর পরিবেশে চিপসটি তৈরি করে।
মুমু