
ছবি: জনকন্ঠ
জন্মের পর পৃথিবীর আলো দেখে প্রতিটি নবজাতক। আলোমাখা রোদের পরশ নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে আলোকিত করে সমাজকে। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য দেখে বুঝে নিজেকে সাজায় আপন গতিতে।
একটা সুন্দর জীবন গড়তে অবিচল চেষ্টা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায় সবাই। কিন্তু জন্মের পর দেখার চোখে যদি আলো না ঝরে, আজন্ম দৃষ্টিহীন হয়ে অবহেলিত জীবন নিয়ে বাঁচতে হয়, সে জীবনে কতটুকু পূর্ণতা থাকে? জীবনের পথে পথে সমাজের গ্লানি আর তিরস্কারের পাত্র হয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার কোনো অর্থই আসে না। এরপরও অন্ধ জীবন নিয়ে পথচলা জাহিদুল ইসলামের।
অন্ধ হয়ে জন্ম নেওয়ার পর মা-বাবাকে পায়নি জাহিদুল। পালিত মা অতিকষ্টে কোনো রকম ভাবে বড় করেন দৃষ্টিহীন তাকে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাহিদুল ইসলাম (৩৪)। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঘনিবিষ্টপুর গ্রামের জাহেদা বেগম ও ইয়াসিন আলী দম্পতির পালিত সন্তান।
জাহিদুলের বয়স যখন তিনবছর তখন মৃত্যু হয় পালিত পিতা ইয়াসিন আলীর। অভাবের সংসার, আয় রোজাগার না থাকায় মা বিধবা জাহেদা বেগম নিত্যদিন খেয়ে না খেয়ে দৃষ্টিহীন জাহিদুলকে নিয়ে অতি কষ্টে দিন অতিবাহিত করেছেন।
উপায়ন্তু না পেয়ে জাহিদুল শুরু করেন গান গেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তি করেই কোনোরকমে চলছিল তাদের অভাব অনটনের সংসার।
প্রতিবেশী সুবেদা বেগম ও মাহাতাবউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩২-৩৩ বছর আগে রুহিয়া রেলওয়ে স্টেশনে জন্ম হয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাহিদুলের। তিনদিন পরে শিশু জাহিদুলকে স্টেশনেই ফেলে রেখে যায় তার গর্ভধারিণী মা।
নিঃসন্তান জাহেদা বেগম ও ইয়াসিন আলী দম্পতি খবর পেয়ে কোলে তুলে নেন তিনদিন বয়সের শিশু জাহিদুলকে।
প্রতিবন্ধী সন্তান যেমন কোনো মায়ের কাছে বোঝা নয়। তেমনই একজন মা জাহেদা কোলে তুলে নেয় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু জাহিদুলকে। পালিত বাবা-মা অন্যের বাড়িতে দিনমজুরের কাজ করে ছেলেকে লালন পালন করেছেন। শিশু জাহিদুলের চিকিৎসাও করিয়েছিলেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
বছর খানেক আগে জাহিদুলের শেষ আশ্রয় তার পালিত মা জাহেদা বেগমেরও মৃত্যু হয়েছে। জাহিদুলকে দেখভালের আর কেউ নাই।
দৃষ্টিহীন জাহিদুলের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, জন্ম হয় রেল স্টেশনে। জন্মের পর আমি আমার বাবা-মাকে দেখিনি, যাদের বাবা-মা হিসাবে জানতাম তাঁরাও পৃথিবীতে আমাকে একা ফেলে চলে গেছে। সূর্যের আলো যে কেমন তাও জানি না। ভিটেমাটি ছাড়া নিজের কোনো জমিজমা নাই।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, আগে আমার মাকে সহযোগিতা করতে গান গেয়ে ভিক্ষা করতাম। এখন মা নাই তাই আর ভিক্ষা পারছি না। কোনো কোনো দিন না খেয়েও থাকতে হচ্ছে। কাপড়-চোপড় ধুতে ও খাওয়া দাওয়া করতে প্রতিবেশীরা সহায়তা করেছে।
খুবই অসুস্থ হয়েছি। কিছু দিন আগে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে প্রতিবেশীরাই। তারা যদি সহযোগিতা না করতো মরা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এই অবস্থায় কোথায় যাব, কি করব, কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না। বাবা মাকে দেখতে পারিনি, কারো সহযোগিতায় যদি চোখের দৃষ্টি ফেরত পাই তাহলে পৃথিবীটা দেখতে পেতাম।
প্রতিবেশী আব্দুস সালাম বলেন, জাহিদুলের খুবই কষ্ট কারণ সে অন্ধ মানুষ। মাঝে মধ্যে আমার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে। কোন কোন দিন না খেয়ে থাকে। তার দুঃখের শেষ নাই। জাহিদুলে গানের গলা অসাধারণ। মাঝেমধ্যে কষ্ট পেলে নিজেই গান তৈরি করে সুর করে। আবার সেই গান স্থানীয় বাজারে গেয়ে বেড়ায়। গান শুনে অনেকেই তাকে টাকা দেয়। কেউ যদি সহযোগিতা করতো তাহলে গান গাওয়ার এই প্রতিভা জাহিদুলকে বহুদূর নিয়ে যেতে পরতো।
রুহিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল হক বাবু বলেন, আমি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী জাহিদুলকে ভালোভাবেই চিনি। পরিবারে আয় করার মতো এবং তাকে দেখভাল করার মতো কেউ নাই। নিজেদের কোনো জমিও নাই। সবসময় সহযোগিতা করেছি। সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও তাকে আরো সহায়তা করার চেষ্টা করব।
মুমু