ডা. অরূপরতন চৌধুরী
২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। জাতিসংঘের মাদকবিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অন ড্রাগ অ্যান্ড ক্রাইম (এনওডিসি) দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ঞযব বারফবহপব রং পষবধৎ: রহাবংঃ রহ ঢ়ৎবাবহঃরড়হ’। ভাবানুবাদ হলো- ‘বর্তমান প্রজন্মকে মাদকমুক্ত রাখতে প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতিরোধ কার্যক্রম’। অর্থাৎ মাদকাসক্তি সমস্যার সামগ্রিক প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সুতরাং মাদক সমস্যা প্রতিরোধ সর্বোপরি প্রতিরোধ কার্যক্রমের প্রতি জোর দিতে হবে। মাদক প্রতিরোধে বাড়াতে হবে বিনিয়োগ।
বাংলাদেশে অনেক সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। তার মধ্যে মাদকাসক্তি বড় একটি সমস্যা। এটি বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাদকাসক্তি একটি রোগ। মাদকদ্রব্য, ধূমপান ও তামাক সেবন মানুষের অকালমৃত্যু এবং স্বাস্থ্যহানির অন্যতম প্রধান কারণ। মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বিপথগামিতাও সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ কিশোর-তরুণ। যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট।
বাংলাদেশে ৪৯% মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ ৪৯% জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। বেসরকারি হিসাবমতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। মাদকসেবীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে ইয়াবা সেবনকারী শতকরা ৮৫ ভাগই তরুণ যুবসমাজ। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশের বেশি কিশোর অপরাধী মাদকাসক্ত এবং তাদের বেশিরভাগই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। উপরন্তু ৮৫ শতাংশ কিশোর অপরাধী মাদক কেনার কথা স্বীকার করেছে। ৫৫ শতাংশ স্বীকার করেছে যে, তারা মাদক বিক্রি করেছে। তাদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকেই পরিচয় ঘটছে মাদকের সঙ্গে। স্কুল-কলেজ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান মাদক সরবরাহের হটস্পটে পরিণত হয়েছে।
জাতি মেধাশূন্য হওয়ার যে ভয়ানক প্রক্রিয়া চলমান তা রুখতে হবে ‘মাদক প্রতিরোধ’ কার্যক্রমে জোর দেওয়ার মাধ্যমে। তা না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। কারণ, কিশোর ও তরুণরা শুধু মাদকদ্রব্যের আসক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা খুন হয়েছেন। স্বামী হত্যা করেছে স্ত্রীকে। স্ত্রী হত্যা করেছে স্বামীকে। খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, পরকীয়া প্রেম, দাম্পত্য কলহ, অর্থ লেনদেন, হত্যা, সন্ত্রাসী কার্যক্রম সকল কিছুর মূলেই রয়েছে মাদকের নেশা। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সেই মানুষ মাদকের নেশায় হয়ে ওঠে হিং¯্র দানব, নরপশু। সুতরাং সামাজিক মূল্যবোধের এই যে চরম অবক্ষয় তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।
মাদকাসক্তি সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন মাদক সংক্রান্ত অপরাধে। মাদকজনিত অপরাধের মাঝে বর্তমানে কিশোর গ্যাং অন্যতম সমস্যা। মাদকের খরচ জোগাতে কিশোর ও কিশোরী উভয়ই এই অপরাধ কর্মকা- পরিচালনাকারী গ্যাংয়ের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এই সকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বিত প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন জরুরি। যেখানে মনোসামাজিক, নৈতিক ও সামাজিকীকরণ শিক্ষা প্রদানসহ এর বিষয়সমূহ সর্বস্তরে পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উদ্বেগজনক বিষয় হলো বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সম্পৃক্ততা। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় অন্যতম বড় অনুষঙ্গ হলো ইন্টারনেট। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় সবখানেই ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে উল্লেখযোগ্যহারে। ইন্টারনেট ও তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগণ্য ভূমিকা এখন দৃশ্যমান। পক্ষান্তরে, কিছু ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের অপব্যবহারও আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
মাদকাসক্তদের শাসন বা ঘৃণা-অবহেলা না করে তাদের স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে নিরাময় কেন্দ্রে পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে হবে, যাতে তারা সমাজের বোঝা না হয়ে সুস্থ হয়ে আবার পরিবারে ফিরে আসতে পারে। তাই পিতা-মাতার প্রতি অনুরোধ, সন্তানকে মাদকাসক্ত হওয়ার কারণে লুকিয়ে রাখবেন না। ঘৃণা করবেন না। বরং তাকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যান। তাকে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিন। সঠিক চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে একদিন তারাই সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।
কিশোরদের মাঝে অপরাধমূলক আচরণ ও মাদকনির্ভরশীল সমস্যা হ্রাসে সুপারিশ
ক্স শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের জন্য মনোসামাজিক শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালনার উদ্যেগ নেওয়া;
ক্সকিশোর-কিশোরীদের মাদকনির্ভরশীলতা সমস্যার চিকিৎসার জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অনুসারে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা;
ক্সবিনোদন মাধ্যমে (নাটক, সিনেমা, ওয়েবসিরিজ) প্রচারের ক্ষেত্রে মাদক ও তামাকের ব্যবহার প্রদর্শন বন্ধ করা। সকল গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা, সতর্কীকরণ তথ্যচিত্র প্রচার করা;
ক্স সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগে মাদকবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করা;
ক্স কিশোর ও তরুণদের প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যুক্ত করা;
ক্স শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদক ও তামাকবিরোধী সেল গঠন ও সচেতনতায় ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া;
ক্স যুব ও ক্রীড়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু , স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও সম্প্রচার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়গুলোকে একসঙ্গে প্রতিরোধ কার্যক্রমে একটি রূপরেখা নিয়ে কাজ শুরু করা;
ক্স প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে ‘ডোপ টেস্ট’ চালু করা;
ক্স সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে নজরদারি বাড়ানো;
ক্স তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে দেশে ই-সিগারেট, ভেপসহ সকল প্রকার ইমার্জিং টোব্যাকোর বিক্রি ও প্রচারণা বন্ধ করা প্রয়োজন।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র), প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)