ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

গৌরবময় অভিযাত্রা

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২২ জুন ২০২৪

গৌরবময় অভিযাত্রা

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

২৩ জুন বাংলাদেশের জন্য, এমনকি ভারতের জন্যও একটি বিশেষ দিন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর আ¤্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা একদল বেইমান-বিশ্বাসঘাতকের কারণে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। এই পরাজয় পুরো ভারতকে ইংরেজ শাসনের অধীনে নিয়ে যায় পরবর্তী ১৯০ বছরের জন্য। ভারত ইংরেজমুক্ত হলেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি দেশ।

কিন্তু পাকিস্তানে বাঙালিরা শুরু থেকেই নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলে, তখন বাঙালিদের জন্য মুক্তির পথ তৈরি করার কোনো বিকল্প ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তারিখটিতে জন্ম হয় আওয়ামী লীগের। আজ সেই ঐতিহাসিক গৌরবময় অভিযাত্রার ‘প্লাটিনাম জুবিলি’। পৃথিবীর বুকে আওয়ামী লীগ সেই বিরল রাজনৈতিক দলগুলোর একটি, যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে।

যেমনটি বলা যায়, ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে’র [১৯১২] ক্ষেত্রে। আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে বর্ণবাদ থেকে মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রাম এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা [১৯৭১] অর্জন করেছে। বিশ্বের মানচিত্রে উদিত হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পতাকা। তাই বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে গণমানুষের দল হিসেবে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অগ্রযাত্রার ইতিহাস আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস একই। আজকে যে আধুনিক বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, সেটাও এসেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কারণে।
শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্বকে কাজে লাগাতে তাঁকে যুগ্ম-সম্পাদক করা হলেও কিছুদিন পর থেকেই সাধারণ সম্পাদকের কাজটি তাঁকেই করতে হতো। অবশেষে ১৯৫৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। বঙ্গবন্ধুর অক্লান্ত শ্রম এবং তেজস্বী নেতৃত্বের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়।

এরপরের ইতিহাস শুধুই আওয়ামী লীগ এবং গণমানুষের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। ১৯৬৬ সালে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যে ছয় দফা দাবি তুলে ধরা হয়, আওয়ামী লীগের তরফ থেকে সেটাকেই মনে করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম একটি পদক্ষেপ। এরপর ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ভূমিকা দলটিকে এই অঞ্চলের একক বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত করে।

শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন দলের অবিসংবাদিত নেতায়। এর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা যুক্ত হওয়ায় শেখ মুজিব আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং বলা হয় সেই জনপ্রিয়তাই সত্তর সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল বিজয় এনে দেয়। ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিল, যার ধারাবাহিকতায় এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। 
অবশ্যম্ভাবীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পেল আওয়ামী লীগ। সরকার প্রধান হলেন দলের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় চার নেতাকে জেলের মধ্যে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী উগ্রবাদীরা। এরপর দেশটাকে লুটপাট করে খেতে থাকে তারা। দীর্ঘদিনের জন্য সামরিক সরকারের শাসনে চলে যায় বাংলাদেশ এবং বিরাট ছন্দপতন নেমে আসে আওয়ামী লীগে। ১৯৮১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বেঁচে যাওয়া দুই মেয়ের বড়জন শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর আওয়ামী লীগের এই ছন্দপতন দূর হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। যুগপৎ আন্দোলনে স্বৈরশাসকের পতন এবং ১৯৯০ সালের একটি সাধারণ নির্বাচনে দীর্ঘ সময় পর আওয়ামী লীগ অংশ নিলেও পরাজিত হয়ে বিরোধী দলে পরিণত হয়। দীর্ঘ একুশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকার পর আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ১৯৯৬ সালে। এরপর আরেক দফায় ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ২০০৯ সালে আবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

তারা বর্তমানে টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারি কিছু আমলা ও আওয়ামী লীগের কিছু নেতার কারণে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি বারবার ক্ষুণœ হয়েছে। একই সঙ্গে দেশে দৃশ্যমান দুর্নীতি ও অর্থপাচার জননেত্রী শেখ হাসিনাও অস্বীকার করেন না।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছে।

অর্থনৈতিকভাবে সামাজিক বৈষম্য রোধ এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের সংবিধানের চারনীতির একটি সমাজতন্ত্র। এই সমাজতন্ত্র মানে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, বৈষম্য কমানো, অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মানুষের জন্য সুবিধা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সময় থেকেই জনগণকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। শেখ হাসিনাও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।

জাতীয় মুক্তি অর্জনের সর্বশেষ ধাপগুলো অর্জনের জন্য দেশের মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য পরিকল্পনামাফিক দেশকে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে আওয়ামী লীগ। স্বৈরাচার-উগ্রবাদমুক্ত রাষ্ট্র কায়েম এবং গণতন্ত্র অর্জন আওয়ামী লীগের অন্যতম বড় অর্জন।

আওয়ামী লীগের ঐতিহ্য সংগ্রাম ও স্বপ্ন বোনার ৭৫ বছর। গত ৭৫ বছরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনীতির ময়দানে অনেক হারিয়ে এদেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, জিয়া-এরশাদ  গণতন্ত্রের নামে যে সেনাশাসন ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্র কায়েম করেছিল, তার মূল উৎপাটন করেছে। ওয়ান ইলেভেনের নায়কদের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। স্বাধীনতাবিরোধী, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করেছে। এদেশ এখন স্বপ্ন দেখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি উন্নত বাংলাদেশের। 

লেখক : অধ্যাপক, সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি);
পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)

×