ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

তিলোত্তমা নগরীর বহুতল ভবন

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ১১ জুন ২০২৪

তিলোত্তমা নগরীর বহুতল ভবন

বিশেষ করে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা

বিশেষ করে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। যে ভবনে তারা বাস করেন তার ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। না পারার কারণ ভবন নির্মাতাদের অসততা। ভূমিকম্প ছাড়াই বহুবার বহু ভবন হেলে পড়েছে। ধসে পড়েছে। রানা প্লাজার ঘটনা তো এখনো সবার স্মৃতিতে স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞ তথ্যে যা জানা যায় তাতে মনে হয় ঢাকা যদি বিধ্বস্ত হয় তো অপরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য হবে। নইলে যে মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় হওয়ার আশঙ্কা করা হয় সামান্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তা সহ্য করার ক্ষমতা ঢাকার আছে

ইতালির ভিসুভিয়াস পর্বতের উপত্যকায় ছবির মতো সুন্দর শহর পম্পেই। ভেতরে ভেতরে ধসে যাচ্ছিল পম্পেই এর সমাজ কাঠামো। পুরোহিতদের ভ-ামি, ক্ষমতাবানদের স্বেচ্ছাচারিতায় সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। সে রকম এক সময়ে হঠাৎ জেগে ওঠে হাজার বছর ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি ভিসুভিয়াস। জ্বলন্ত আগুনের লাভায় তলিয়ে যায় অপরূপ পম্পেই। ঘটনা ঊনআশি খ্রিস্টাব্দের।

দেবী আইসিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ভ- আর্বেসিস তরুণ এপিসাইডেসকে হত্যা করে দায় চাপায় নির্দোষ পর্যটক গ্লকাস-এর ওপর। সিদ্ধান্ত হয় এ্যাম্ফি থিয়েটারে সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে গ্লকাসকে। আর চারদিক থেকে দর্শকরা উপভোগ করবে সিংহের হিং¯্র আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত গ্লকাসের মৃত্যু। কিন্তু এ দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে গোটা পম্পেই কেঁপে ওঠে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে। তারপর অগ্ন্যুৎপাত। বেঁচে যায় তিন সৎ মানুষ। গ্লকাস, আয়োন এবং নিডিয়া।

ব্যারন এডওয়ার্ড বুলওয়ের লিটন এর এ উপন্যাসে সমাজের নানা অসঙ্গতির পাশাপাশি প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের চিত্রকল্প পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ না কেটে পারে না। ভূমিকম্প হলে তাই মনে পড়ে পম্পেই এর কথা। ঢাকাও কি পম্পেই হবে? অগ্ন্যুৎপাত নয়, ঢাকা নাকি প্রবল ভূমিকম্প-ঝুঁকিতে। এ নিয়ে আতংকিত নগরবাসী। বিশেষ করে বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। যে ভবনে তারা বাস করেন তার ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। না পারার কারণ ভবন নির্মাতাদের অসততা।

ভূমিকম্প ছাড়াই বহুবার বহু ভবন হেলে পড়েছে। ধসে পড়েছে। রানা প্লাজার ঘটনা তো এখনো সবার স্মৃতিতে স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞ তথ্যে যা জানা যায় তাতে মনে হয় ঢাকা যদি বিধ্বস্ত হয় তো অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য হবে। নইলে যে মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় হওয়ার আশঙ্কা করা হয় সামান্য ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তা সহ্য করার ক্ষমতা ঢাকার আছে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ভবন নির্মাণ বিষয়ক আইন বা বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করলে সাত মাত্রার ভূমিকম্পেও তেমন কোনো ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি বা সিডিএমপি থেকে বাংলাদেশের ভূমিকম্পবিষয়ক সবশেষ এক গবেষণায় (২০০৯ সালে) দেখা গেছে, দেশের ভূগর্ভে মাঝারি বা তীব্র ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো যে ফাটল ছিল, তা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।

অর্থাৎ দেশের ভেতরে মাঝারি বা তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই। মূল ভয় দেশের তিন দিকে মিয়ানমার, নেপাল ও ভারতের ভূমিকম্প। এ তিন দেশের ভূগর্ভে মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার মতো ফাটল রয়েছে। এসব এলাকায় আট থেকে দশ মাত্রার ভূমিকম্প হলে তা বাংলাদেশে বড়জোর মাঝারি মাত্রায় অনুভূত হবে। জলাভূমি ভরাট করে এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিত নগরায়ণ বাড়ছে। এতে এই মাঝারি ভূমিকম্পেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
১৯৯৩ সালে রাজউক বিজয় সরণিতে র‌্যাংগস ভবন স্থাপনের অনুমোদন দেয়। আবার পরের বছরই পুরনো বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলে ছয়তলার পর থেকে ওপরের অংশের নকশার অনুমোদনে আপত্তি তোলে। আপত্তি উপেক্ষা করে প্রভাবশালী মালিকের নির্দেশে তরতরিয়ে আকাশছোঁয়া বাইশতলা ভবন। শুধু রাজউক নয়, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশও উপেক্ষা করেছিল মালিক পক্ষ। এক যুগের মাথায় সব শেষ। অসংখ্য করুণ কাহিনী জন্ম দিয়ে ধুলায় মিশে অত বড় স্থাপত্য।
র‌্যাংগস ভবনের পুরোটাই হয়ত রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদলের খেয়াল ছিল। কিন্তু প্রকৃতিরও খেয়াল আছে। সামাজিক রাজনৈতিক প্রভাবে তাকে বাঁধা যায় না। ভবন দাঁড়াবে যে মাটির ওপর সে মাটির যেমন ধারণ ক্ষমতার ব্যাপার আছে, তেমনি যারা ভবন বানাবেন তাদেরও প্রযুক্তিকে ধারণ করার ক্ষমতা থাকতে হয়। জোর করে বা প্রভাব খাটিয়ে সব হয় না। বহুতল ভবন নির্মাণেরও কিছু নিয়ম আছে।

তা না মানলে কী হয় পূর্বনাখালপাড়া বাজারের কাছে নির্মাণাধীন সতেরো তলা ইমপালস হাসপাতালের বিপর্যয় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে দু’হাজার এগারোয়। রাজউকের চেয়ারম্যান সে সময় বলেছিলেন, বিল্ডিং কোড না মানাই ওই বিপর্যয়ের কারণ। কিছু লোক কোম্পানি খুলে অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। বিল্ডিং কোড মানার জন্য যতটুকু শিক্ষা বা সচেতনতা থাকা দরকার তা এদের নেই।
দেশে ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ব্যবসা রমরমা। আইনের ফাঁক গলে রাজউকের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে যেখানে সেখানে ইচ্ছেমতো খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। যতদিন না ব্যবসার এ জায়গাটি পরিচ্ছন্ন ও প্রফেশনাল হচ্ছে অন্তত ততদিন মালিক পক্ষের পূর্ণ সচেতনতা দরকার।

ডেভেলপারকে জমি দেয়ার আগে খোঁজখবর নেওয়া থেকে শুরু করে বিল্ডিং কোড ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে যথাযথ খোঁজ রাখা উচিত। কারণ ভবন তৈরির ঝক্কির চেয়ে তা ধসে যাওয়ার ম্যানেজমেন্টের ঝক্কি অনেক বেশি। বিল্ডিং কোডের খোঁজ রাখেন এমন ল্যান্ড ওনার কমই আছে।
বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মাণকাজ করায় রাজউকের আওতায় নির্মিত অনেক বড় ধরনের সব ভবন বিপর্যয় হয়েছে। রাজউক কর্তৃপক্ষ জোর গলায় বলে, এ জন্য দায়ী বিল্ডিং কোড এবং রাজউকের বিধিমালা না মানা। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে বিধিমালা না মানার বিষয়টি রাজউক আগে দেখে না কেন? ভবন ধসের পর তাদের নানা ধরনের যুক্তি বিশ্লেষণ শোনা যায়।

কিন্তু নকশা পাস বা নির্মাণকাজের সময় তাদের তদারকি থাকে না কেন? তাদের মতো এত বড় প্রতিষ্ঠান থাকতে অবৈধ নকশায় স্থাপনা হয় কিভাবে? বিল্ডিং কোড মানার ব্যাপারে তাদের নিজস্ব উদ্যোগ নেই কেন? নিয়মানুযায়ী নতুন নির্মাণ বা পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের অবস্থা নিয়মিত মনিটরিংয়ের দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু অপর্যাপ্ত জনবলের অজুহাতে এ কাজ তারা এড়িয়ে যায়।

প্রথমে ডিআইটি, পরে রাজউক হওয়ার আগে পুরান ঢাকায় অনুমোদনহীন অসংখ্য বাড়ি নির্মাণ হয়েছে। রাজউকের অনুমোদন নেওয়া অথচ অনুমোদিত নকশার বাইরে তৈরি করা ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িও রয়েছে। রাজউকের কাছে এর পরিসংখ্যান থাকলেও এ নিয়ে তারা উদ্যোগী নয়। রাজধানীতে পাঁচ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ির তালিকা তারা করেছিল এবং সেগুলো ভাঙ্গার প্রস্তাব দিয়েছিল।

তা আর তেমন এগোয়নি। ভাঙ্গা প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য ও কাজ ঢাকা সিটি করপোরেশনের। সিটি করপোরেশন আটকে আছে হেরিটেজ-নন হেরিটেজ প্রশ্নে। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ নিয়ে শুধু আলোচনা-পর্যালোচনাই হয়েছে।
বিল্ডিং কোড প্রণয়ন হয়েছিল আরও আগে ১৯৯৩ সালে। অনুমোদন ও গেজেট প্রকাশ হয় ২০০৬ সালে। ভূমিকম্প রোধসহ নিরাপদ ভবন নির্মাণে শৃঙ্খলা আনার জন্য এ কোড প্রণয়ন হয়েছিল। কোডে উল্লেখ রয়েছে, সরকার একটি নতুন কর্তৃপক্ষ করে এই কোড প্রয়োগ করবে।

নতুন কর্তৃপক্ষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারি বিধিবদ্ধ সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। প্রস্তাব ছিল, ঢাকায় রাজউক, চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং খুলনায় খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন জেলায় গণপূর্ত অধিদপ্তর বা পৌরসভাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে।
আয়োজন আইন নীতিমালা বিধিমালা অনেক আছে কিন্তু যা ঘটার তা ঘটছেই। নির্মাতা কোম্পানির অসাবধানতার জন্য যে সব দুর্ঘটনা ঘটছে তার জন্য উল্লেখযোগ্য শাস্তির দৃষ্টান্ত নেই। যতদিন কলম ও ক্যামেরা সজাগ থাকে ততদিনই জানাজানি, তারপর আবার সেই ধামাচাপা। এভাবে কি চলতে পারে একটি মেট্রোপলিটন শহর?
নগর উন্নয়ন আইন (১৯৫৩) অনুযায়ী, রাজউকের আসল দায়িত্ব হচ্ছে নগর পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও উন্নয়ন কাজ তদারকি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লোকবল সংকটের অজুহাত না তুলে রাজউকের উচিত তার মূল কাজে মনোযোগ দেওয়া।
অনুমোদিত নকশায় পরিবর্তন এনে ভবন নির্মাণ অথবা অনুমোদনহীন পাঁচ হাজার ভবনের তালিকা রাজউকের কাছে রয়েছে। কিন্তু যে সব স্থপতি এসব ভবনের নকশা তৈরি করেছেন এবং যে প্রকৌশলীরা ভবন নির্মাণে সহায়তা দিয়েছেন তাদের অনেকেই রাজউকের তালিকাভুক্ত। ইমারত নির্মাণ আইন (২০০৬ সংশোধিত) অনুযায়ী, এদের তিন বছরের কারাদ- এবং বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

রাজউক তার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে না বললেই চলে। অনুমোদিত নকশায় কাজ শুরুর পনেরো দিন আগে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির পক্ষ থেকে রাজউককে জানানোর কথা থাকলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি তা করে না। এ জন্য রাজউক ওই নকশার অনুমোদন বাতিল করে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দিতে পারে।

×