![পবিত্র মক্কায় আদি পিতা আদম ও মা হাওয়া (আ.) পবিত্র মক্কায় আদি পিতা আদম ও মা হাওয়া (আ.)](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/Islam-prashang-2405231443.jpg)
প্রসঙ্গ ইসলাম
মহান আল্লাহ হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) কে বেহেশ্ত থেকে দুনিয়ায় পাঠান। তারা দুনিয়ার কোন্ জায়গায় অবতরণ করেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। ইবনে জারীর আত্তাবারী লিখেছেন, এক বর্ণনা অনুযায়ী আদম (আ.) কে ভারতবর্ষে অবতরণ করানো হয়। বেহেশ্ত থেকে ভারত ভূখণ্ডে অবতরণের কারণে তখন ভারতের গাছপালা বেহেশতী সুঘ্রাণে মোহিত হয়।
হজরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) এর মতে, আদম (আ.) কে ভারত এবং হাওয়া (আ.) কে জেদ্দায় অবতরণ করানো হয়। দুনিয়াতে একাকী অবতরণ করার পরপরই আদম (আ.) তাঁর সঙ্গিনী হাওয়া (আ.) কে খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে আদম (আ.) আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হন এবং সেখানে হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হাওয়া (আ.) মুযদালিফায় আদম (আ.)-এর সঙ্গে মিলিত হন। অভিধানে আরাফাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে পরিচয় বা জানাশোনা এবং মুযদালিফা শব্দের অর্থ হচ্ছে মিলিত হওয়া।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে, আদম (আ.) সরন্দীপ (বর্তমানে শ্রীলংকার) চুজ নামক পাহাড়ে এবং হাওয়া (আ.) জেদ্দায় অবতরণ করেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ বস্ত্রহীন আদম ও হাওয়ার সতর ঢাকার উদ্দেশ্যে বেহেশত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে তা জবেহ করার নির্দেশ দেন। এরপর তারা উভয়ে দুম্বার পশম দিয়ে নিজের জন্য লম্বা জামা ও ওড়না তৈরি করেন।
তারা বেহেশতে থাকা অবস্থায় পোশাক পড়েছেন। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার কারণে তাদের বেহেশতী পোশাক খসে পড়ে। তাই তারা বেহেশতের পাতা দিয়ে সতর ঢাকার চেষ্টা করেন। দুনিয়াতে অবতরণের পরপরই তাদের সেই বেহেশতী অভ্যাস বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাদের পোশাকের ব্যবস্থা করে দিলেন।
তাই যে সকল ঐতিহাসিক মানব ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়কে পুরাতন ও নতুন পাথর যুগ এ দু’ভাগে ভাগ করে বলেন, প্রাথমিক যুগের মানুষ অসভ্য ছিল, তারা পোশাক না পরে উলঙ্গ থাকত- তা নিতান্ত আন্দাজ-অনুমান ও ভিত্তিহীন বক্তব্য।
ই্বনে জারী উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ আদম (আ.)-এর কাছে অহী পাঠিয়ে বলেন, ‘আমার আরশ বরাবর নিচে একটি হারাম বা সম্মানিত জায়গা আছে। তুমি সেখানে গিয়ে আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একটি ঘর তৈরি কর এবং আমার আরশের চারপাশে তাওয়াফকারী ফেরেশতাদের মতো তুমিও এর তাওয়াফ কর। সেখানে আমি তোমার ও তোমার সন্তানদের দোয়া কবুল করব।’ হজরত আদম (আ.) জবাবে বলেন, হে আল্লাহ! সে জায়গাটি তো আমি চিনি না। তারপর একজন ফেরেশতা তাঁকে সেখানে নিয়ে যান।
তিনি পাঁচ পাহাড়ের পাথর দিয়ে মক্কায় আল্লাহর ঘর কা’বা তৈরি করেন। পাহাড়গুলো হচ্ছে, ১. তুরে সিনাই ২. তুরে যাইতুন বা যাইতা ৩. লুবনান পাহাড় ৪. যুদি পাহাড় ৫. হেরা পাহাড়। তারপর ফেরেশতা তাঁকে আরাফাতে নিয়ে যান এবং হজের সকল নিয়মÑকানুন শিক্ষা দেন। তিনি এক সপ্তাহ যাবৎ আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করেন। সবশেষে তিনি ভারত ফিরে যান এবং চুজে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে মতভেদ আছে।
এক বর্ণনায় এসেছে, আদম (আ.) বেহেশত থেকে আসার সময় সঙ্গে করে এক কলসী গম নিয়ে এসেছেন। আরেক বর্ণনায় এসেছে, আদম (আ.) ক্ষুধার্ত হওয়ায় জিবরীল (আ.) ৭টি গম নিয়ে আসেন এবং আদমকে বলেন, এগুলো জমিনে চাষ করুন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাতে ফসল দিয়ে দেন। তারপর জিবরীল (আ.) তাঁকে ফসল কাটা ও ফসল সংগ্রহ করার পদ্ধতি শিক্ষা দেন।
জিবরীল (আ.) তাঁকে এক পাথরের ওপর গম রেখে অন্য পাথর দিয়ে তা পিষে গুঁড়ো করে রুটি তৈরির নির্দেশ দেন। পরে জিবরীল (আ.) লোহা ও পাথরের ঘর্ষণে আগুন জ্বালিয়ে রুটি তৈরির পদ্ধতি শিক্ষা দেন। এটাই বনি আদমের প্রথম রুটি ছিল। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ই.জরীর ১ম খ.)। ইবনে কাসীর বলেছেন, ‘দুনিয়ার আবাদীর জন্য আদম (আ.)-এর ঘরে জোড়ায় জোড়ায় সন্তান হয় এবং তাদের মধ্যে পরস্পরে বিয়েÑশাদি অনুষ্ঠিত হয়।’
আদমের দু’পুত্র সন্তান হাবিল ও কাবিল। হাবিল নিজ জমজ সুন্দরী বোনকে কাবিলের কাছে বিয়ে না দেওয়ায় কাবিল হাবিলকে হত্যা করে। সূরা বাকারায় ঘটনাটি উল্লেখ আছে। হাবিলকে হত্যার পর কাবিল ইয়েমেনে পালিয়ে যায়। শয়তান সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে বলে, তোমাদের দুজনের পেশকৃত কুরবানির মধ্যে আগুন এসে হাবিলের কুরবানি গ্রহণ করার কারণ হলো হাবিল আগুনের পূজা করত।
তুমিও তাই কর। তখন কাবিল একটি ঘর তৈরি করে তাতে সর্বপ্রথম আগুনের পূজা শুরু করে। (প্রাগুক্ত)। হাবিলের পরিবর্তে আল্লাহ আদম (আ.) কে শীষ নামক এক নেক সন্তান দান করেন। মৃত্যুর সময় আদম (আ.) তাঁকে রাত ও দিনের ঘণ্টাসমূহ এবং সেগুলোর নির্দিষ্ট ইবাদতের বিষয়ে উপদেশ দেন ও নিজ দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
আবু জার (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ মোট ১০৪টি আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এর মধ্যে একমাত্র হজরত শীষ (আ.)-এর ওপরই ৫০টি কিতাব নাযিল হয়। মোহাম্মদ বিন ইসহাকের মতে, বনি আদমের সকল বংশ শীষ (আ.) পর্যন্ত গিয়ে মিশেছে এবং আদম (আ.)-এর অন্য ছেলেদের বংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শীষ (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আনুস তাঁর দায়িত্ব পান। পরে তার ছেলে কীনান ও কীনানের ছেলে মাহলাইল উক্ত দায়িত্ব পালন করেন।
এক পর্যায়ে মাহলাইলের ছেলে ইয়ারদ এবং ইয়ারদের ছেলে খানুক বা ইদরিস (আ.) উক্ত দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। আদম, শীষ এবং ইদরিস (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে নবুওত পান। কলম দিয়ে ইদরিস (আ.) প্রথম লেখার সূচনা করেন। মে’রাজের রাতে ৪র্থ আসমানে তাঁর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাক্ষাৎ হয়।
এরপর নবুওত লাভ করেন হজরত নূহ (আ.)। আল্লাহ নূহ (আ.) কে তাঁর গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট জাতির হেদায়েতের জন্য পাঠান। তারা মূর্তিপূজাসহ আরও বহু পাপকাজে লিপ্ত ছিল। তিনি ৯৫০ বছর যাবৎ তাঁর জাতিকে সংশোধনের চেষ্টা করে সামান্য কিছু লোককে মাত্র সংশোধন করতে সক্ষম হন। আল্লাহ নূহের নৌকায় আরোহী সীমিত সংখ্যক মোমেনকে বাদ দিয়ে কওমের অবশিষ্ট সবাইকে বন্যার পানিতে ডুবিয়ে মারেন।
বন্যার পানি শুকিয়ে নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদী পাহাড়ে এসে থামে। জুদী পাহাড় কুর্দিস্তান এলাকায়। এরিস্টটলের শিষ্য আবীডেনাস নিজ ইতিহাসে ঐ সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছেন যে, ইরাকের অসংখ্য মানুষের কাছে ঐ জাহাজের চূর্ণ টুকরা সুরক্ষিত ছিল। তারা সেগুলো ধুয়ে বা গুঁড়া করে রোগীকে ওষুধ হিসেবে সেবন করাত। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ই.জরীর ১ম খ.)।
তিরমিযী শরীফে হজরত সামুরা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নূহ (আ.)-এর তিন ছেলের মধ্যে সাম থেকে আরব, হাম থেকে হাবশা (আফ্রিকান নিগ্রো) এবং ইয়াফেস থেকে রোম (ইউরোপীয়) শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব