সিডনির মেলব্যাগ
১৯৯৬ সালে যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসি তখন সিডনিতে বাঙালি জনসংখ্যা ছিল অপ্রতুল। বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর হাজার দশেক মানুষ থাকতেন বাণিজ্যিক রাজধানী সিডনিতে। এই স্বল্প জনগোষ্ঠীর কাজকর্মের ব্যস্ততা ছিল। ছিল গুছিয়ে নেওয়ার তাগিদ। ফার্স্ট জেনারেশন নামে পরিচিত এই মানুষগুলো তখন কাজ খুঁজতে ব্যস্ত। তাদের বিনোদন ছিল বাড়ি বাড়ি ঘুরে আড্ডা দেওয়া আর যার যার ধর্ম চর্চা করা। সে কারণে ঈদ, পূজা এবং এগুলোর কমিটিই তখন সমাজ শাসন করছিল। বাঙালি সামাজিক জীব।
দেশ থেকে আসার সময় তারা সংস্কৃতি নিয়ে আসতে ভুল করেনি। আমাদের সংস্কৃতি যে কতটা প্রবল আর প্রভাব বিস্তারকারী, সেটা ইতিহাসেই লেখা আছে। বাঙালি মহান মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা আর একুশে নিয়ে গর্বিত। দুনিয়ার সব দেশে তারা এই দিনগুলো পালন করে। মর্যাদার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে লালন করে। কিন্তু রাজনীতি তার জটিল থাবা থেকে একটি দিনকেও মুক্তি দেয়নি। সে কারণে সর্বজনগ্রাহ্য ও স্বীকৃত হওয়ার পরও দিনগুলো রাজনৈতিক কারণে বহুধাবিভক্ত। কিন্তু একটিমাত্র জাতীয় দিন বা উৎসব আছে, যা নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না। সে দিনটি বাংলা নববর্ষ।
সিডনিতে সে সময়ে বৈশাখী মেলা হতো। মেলাটি প্রথমবার দেখতে গিয়ে কিছুটা হতাশই হয়েছিলাম। একটা গার্লস স্কুলের উঠানজুড়ে অল্প কিছু দোকানপাট। মানুষ দলে দলে সেখানে ভিড় করলেও মেলাটি ছিল ছোট পরিসরে। তবে মানতে হবে গুণগতমান আর সাংস্কৃতিক আয়োজনে বারুড স্কুলের মেলাটিকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিল বঙ্গবন্ধু পরিষদ।
ড. আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন এই পরিষদের মেলাটি মনে দাগ কাটতে শুরু করে তখন থেকেই। বলাবাহুল্য, বাঙালি সবটাতে বিভক্ত এবং তাদের কর্মপ্রবাহ বহুগামী। কালে কালে একাধিক বঙ্গবন্ধু পরিষদের জন্ম হয়। তারাও সাড়ম্বরে পালন করে বৈশাখী মেলা। তাদের মেলাতেও ভিড় করে মানুষজন। সময় যায়, মেলার পরিধি আর জনসংখ্যা বাড়তে থাকে ক্রমাগত। বঙ্গবন্ধু পরিষদের যে অংশটি ড. আবদুর রাজ্জাকের, তারা নাম পরিবর্তন করে হয় বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল। এর ফাঁকেই গড়ে ওঠে আরেক ইতিহাস।
ছোটখাটো পরিসর থেকে সোজা পৌঁছে যায় অলিম্পিক ময়দানে। সেই অলিম্পিক ময়দান, যেখানে ২০০০ সালে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অভিবাসনের তিন বছর বয়সে এর কর্মপ্রবাহ দেখে বিস্ময়ে থ বনে গিয়েছিলাম। যে জায়গাগুলো ছিল বনবাদাড় আর দু’একটি কারখানা পরিবেষ্টিত, এক বছরের মাথায় সেগুলো বদলে গেল। এমনই বদলানো যার নাম ম্যাজিক। গড়ে উঠল ভবন খেলার মাঠ। বিশ্বনন্দিত সব খেলার মাঠ আর স্টেডিয়াম।
সে ধরনের একটি স্টেডিয়ামে আয়োজিত বঙ্গবন্ধু পরিষদ ড. রাজ্জাক-শামীমের বৈশাখী মেলা পা বাড়াল নতুন ইতিহাসের দিকে। এখন যা শেখ শামীমের নেতৃত্বে চলমান। ভেন্যু পরিবর্তিত হলেও এর ধারাবাহিকতা আর বহুজাতিক মনোভাব ও অংশগ্রহণে মেলাটি আজ নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে বিশ্বনন্দিত। এত জনসমাগম আর কোনো মেলায় হয় না।
গামা আবদুল কাদির, প্রয়াত নূরুল আজাদ পরবর্তীকালে শাহজাদাদের মতো তরুণরা যে মেলাটি করেন, তার গুরুত্বও অপরিসীম। এসব মেলায় বাংলাদেশের স্বনামধন্য মানুষ শিল্পী অভিনেতাসহ অনেকেই হাজির থাকেন। ওপার বাংলার বিশিষ্ট শিল্পীরাও বাদ যান না। বঙ্গবন্ধু কাউন্সিলের মেলাতেই প্রথম বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনেতা আরেফিন শুভ’র হাতে খড়ি ঘটে। পরবর্তীকালে এই অভিনেতা শ্যাম বেনেগাল নির্মিত বঙ্গবন্ধু বায়োপিকে অভিনয় করে ইতিহাস রচনা করেছেন। যার সূতিকাগার সিডনির বৈশাখী মেলা।
সিডনতেই শুধু নয়, মেলবোর্নেও হয় জমজমাট বৈশাখী আয়োজন। মেলার আয়োজন নিয়ে ক্রিয়েটিভ এন্টারটেইনমেন্টের প্রেসিডেন্ট তৌহিদ পাটোয়ারী এসবিএস বাংলাকে জানান, ‘বাংলাদেশের বাইরেও বিশ্বজুড়ে বৈশাখী উৎসব একটি মেগা ইভেন্ট। ইউরোপে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয় বৈশাখী উৎসব। লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলাটি যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম লোক উৎসব। প্রায় আশি হাজার লোক সমাগম হয় মেলাটিতে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনুষ্ঠিত মেলাগুলোর আকারও বেশ বড়। প্রায় ত্রিশ হাজার লোক সমাগম হয় সিডনির একটি মেলায়। বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোক উৎসব হিসেবে বিবেচিত উৎসবটি বিশ্বজুড়ে সকলের জন্য একটি আনন্দ উৎসব হিসেবে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মেলবোর্নের বৈশাখী আয়োজনে সেক্ষেত্রে একটি শূন্যতা ও অপূর্ণতা রয়ে গেছে। কমিউনিটির সেই প্রত্যাশিত চাহিদা পূরণ করতেই এই মেলাটি অনুষ্ঠিত ওয়েরেবি রেসকোর্স গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড ও সংলগ্ন মাঠে।’
বৈশাখী মেলা আউটডোর ইভেন্ট। অডিটোরিয়ামের মধ্যে বৈশাখী মেজাজ ও আমেজ আসে না। অন্যদিকে এপ্রিলের আবহাওয়া আউটডোর ইভেন্টের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেদিক থেকে ওয়েরেবি রেসকোর্সের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড ও স্টল ফেসিলিটিজে ছাউনি থাকায় দুই দিক থেকেই ঝুঁকিমুক্ত। ধারণ ক্ষমতার দিক থেকেও অনন্য। অন্তত বিশ হাজার দর্শক ধারণ করতে সক্ষম ভেন্যুটি। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য বিশ হাজার বা তারও বেশি অংশগ্রহণকারী। ধারণা করি এখন এই বৈশাখী মেলা সেখানেও জমজমাটভাবে অব্যাহত আছে।
আরেকটি বড় শহর এডেলেইড। যে বছর সেখানে প্রথম বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এডেলেইডের বাসিন্দা এবং ঝঅইঈঅ সভাপতি মাহবুব সিরাজ তুহিন এসবিএসকে জানান, সংগঠনের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং বৈশাখী মেলা উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বাণী দিয়েছিলেন। যে বাণীতে তিনি অস্ট্রেলিয়াকে বহু ভাষা-সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসের দেশ উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশী কমিউনিটি স্পষ্টতই অস্ট্রেলিয়ার এই মূল্যবোধকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছে এবং বিশ্বের কাছে অস্ট্রেলিয়াকে সুখী ও সৌহার্দ্যরে দেশ হিসেবে পরিচিতি দিতে সহযোগিতা করছে।
পার্থসহ আরও বিভিন্ন শহরে বৈশাখী মেলা আয়োজিত হয়ে থাকে। যা এখন খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। আগেই লিখেছি আমাদের জাতি সংস্কৃতিনির্ভর। সংস্কৃতি ছাড়া আমাদের চলে না। আপোদে বিপদে সংকটে আনন্দে সংস্কৃতিই আমাদের চালিকাশক্তি। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও এই শক্তি চলমান। যা অন্ধত্ব সাম্প্রদায়িকতা আর কুসংস্কার প্রতিরোধ করে। বাঙালিকে দেয় বাঁচার প্রেরণা।
ইউরোপ আমেরিকায় বাঙালি বা বংলাদেশীদের বসবাস অনেক পুরনো। সে কারণে তাদের সঙ্গে এখনো আমাদের তুলনা চলে না। কিন্তু এটাও সত্য অস্ট্রেলিয়া তথা প্রশান্তপাড়ে বাংলাদেশীরাও থেমে নেই। এই শুভযাত্রা আরও দীর্ঘ হোক। বাংলা বাঙালির জয়যাত্রায় আমাদের নামও ইতিহাস জায়গা করে নিক। এটা সময়েরও চাহিদা। জয় বাংলা জয়তু বাঙালির নববর্ষ।
সিডনি