.
সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকার-জনগণের নানান সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিশ্বস্বীকৃত। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোড়কে ভারতবিরোধী প্রচার-প্রচারণার বেড়াজালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিগত পাঁচ দশকে এক দুর্গম পথ পরিভ্রমণ করেছে। সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এর নতুনমাত্রা অতিশয় দৃশ্যমান। কথিত পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সরকার নির্বাচন করতে সমর্থ হয়েছে এমন কদর্য ধারণার বশবর্তী হয়ে দেশবিরোধী অশুভ-অপশক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ এবং ‘বয়কট ইন্ডিয়া প্রোডাক্টস’ দুটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। সর্বশেষ চলতি মাসে হাতেগোনা কয়েকটি কথিত বিরোধী দল তাতে সংহতি জানিয়ে একে রাজনৈতিক রূপদানের অপচেষ্টা জাতি চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অবলোকন করছে।
বিশ্লেষকদের মতানুসারে, ভারতীয় পণ্যের উপর বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর বাংলাদেশে কমপক্ষ ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ভারত। ভারতীয় পেঁয়াজ-চাল-মসলা না এলে দেশের বাজারে এগুলোর দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় পণ্য বিলাসিতার জন্য নয় বরং বেঁচে থাকার জন্য ব্যবহার করতে হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই সময়ে ভারতীয়, ইউরোপীয় বা মার্কিন পণ্য বলে তেমন কোনো কিছু নেই। কোনো পণ্যই এককভাবে কোনো দেশের নিজস্ব নয়। এছাড়া ভারতীয় বা অন্য যেকোনো দেশের পণ্য বর্জন বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটিকে উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-ভাবনা ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। অধিকাংশ ভারতীয় পণ্যের বিকল্প সাধারণ মানুষ যেমন জানে না, সব রকম চাহিদা পূরণের বিকল্পও তেমন গড়ে ওঠেনি। কাজেই সাময়িকভাবে আন্দোলনটি আলোচনায় এলেও এটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে। আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে দেশের জনগণও ওয়াকিবহাল। সব মিলিয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি জনগণকে বিচলিত করার প্রশ্নই উঠে না।
জাপানের বিখ্যাত পত্রিকা নিক্কেই এশিয়ার গবেষণা মারফত জানা যায়, ভারত বয়কট বিষয়টি অনলাইনে প্রচুর প্রচারণা চললেও বাস্তবে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। ভারতীয় পণ্য আমদানিকারকদের দাবি, এখন পর্যন্ত আমদানিতে কোনো তারতম্য নেই। তাছাড়া এই প্রচারণায় যেসব পণ্য বর্জনের কথা বলা হচ্ছে, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সেগুলোর অনুপাত খুবই সামান্য। দেশটি থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে শিল্প কাঁচামাল। সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড-ভিয়েতনাম-চীন-কোরিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ঘরে ব্যবহারের যেসব পণ্য আসে তার তুলনায় ভারতীয় পণ্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসলে কোনো দেশের পণ্য বয়কট করা কতটা সম্ভব তা নির্ভর করে আমাদের চাহিদা আছে কি নাই তার উপরে। ভারত থেকে নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য অধিকতর সুবিধা পাওয়া সাপেক্ষে আমদানি করা হয়। বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত স্থলবন্দরের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিএন্ড এফ) এজেন্টদের ভাষ্যমতে, তিন মাস আগে দিনে তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করত। এখন কোনো কোনো দিন সেই সংখ্যা চারশ’ ছাড়িয়ে যায়। ডলার সংকট, এলসি জটিলতার মতো বিষয় বহাল থাকলেও নতুন করে আমদানির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন বা কমবেশি হয়নি।
ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমরা ভারত থেকে যা আমদানি করি তার মধ্যে ভোগ্যপণ্য সবচেয়ে বেশি। এরপরে রয়েছে গার্মেন্টস এবং ওষুধের কাঁচামাল। অন্যান্য পণ্য তেমন নয়। আমরা এগুলো ভারত থেকে কম্পিটিটিভ প্রাইসে পাই বলে আনি, আর এত কম সময়ে অন্য কোনো দেশ থেকে তো আনা যায় না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নানা ট্যারিফ, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার আছে। সেটা কমানো গেলে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়বে। উত্তর ও পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের বিলাস সামগ্রীসহ নানা পণ্যের চাহিদা আছে। কয়েকটি গ্রুপের বড় বাজারসহ ভারতে আমাদের ইনফর্মাল ট্রেড আছে। আমরা যদি ভারতের পণ্য বর্জনের কথা রাজনৈতিক কারণে বলি আর যদি তারা এর প্রতিক্রিয়ায় কোনো পণ্য দেওয়া বন্ধ করে তাহলে এখানে ক্রাইসিস হবে। ভারত আমাদের আমদানির দ্বিতীয় অবস্থানের দেশ। সাপ্লাই চেন বাধাগ্রস্ত হলে অনেক ভোগ্যপণ্যের ক্রাইসিস হবে। তাতে সিন্ডিকেটে যারা যুক্ত তারাই লাভবান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডলার ক্রাইসিসের কারণে দুই দেশের বাণিজ্য কমলেও এখন ভারতীয় রুপিতে ব্যবসা চালু হওয়ায় আমদানি, রপ্তানি আবার বাড়ছে।’
এটি অবশ্যই স্মরণযোগ্য, স্বাধীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক সুদৃঢ় এবং সহযোগিতার নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। ওই সফরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব-শান্তি-সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু গঙ্গা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক নদীর সুষম পানি বণ্টন ও ছিটমহল হস্তান্তরের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। ১৯৭৪ সালে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল ও সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় কিছু অতিরিক্ত ভূমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তিনি ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ ও শক্তিশালী ভূমিকার জন্য ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ফারাক্কা বাঁধসংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করে। সরকারি বা নীতিগত পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে দুই দেশের সম্পর্কে নানা টানাপোড়েন পরিলক্ষিত হয়।
১৯৭৭ সালে ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতন হলে দুই দেশের সম্পর্কের কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হলে ১৯৭৯ সালে গঙ্গা নদীর স্বল্পমেয়াদি পানি বণ্টন চুক্তি এবং ১৯৮০ সালে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতে ১৯৮০ সালে পুনরায় কংগ্রেস সরকার এবং ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে সরকারের পরিবর্তন ঘটলেও এ পার্থক্য বিরাজিত থাকে। ওই সময়ে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতাকে জোরদার করার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন কাঠামো গড়ে তুলতে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সার্ক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাবর্তনে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি প্রাধান্য পেলেও নিরাপত্তা বা অন্যান্য বিষয়ে ধারাবাহিকতার বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয় দীর্ঘ সময় ধরে অমীমাংসিত গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি’ সম্পাদনে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া তা সম্ভব হতো না বলে বিজ্ঞজনদের ধারণা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোট সরকারের জয়লাভের ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে নবতর অধ্যায় রচিত হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অধীনে ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হওয়া নতুন চুক্তির আওতায় রয়েছে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরও কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শক্তি-জ্বালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে অবারিত সুসম্পর্ক অত্যন্ত সুদৃঢ়। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুই দেশই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ বিরোধী কৌশলগত অংশীদার হিসেবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে অতিশয় সফল ও সার্থক।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিশ্ববাজারে এলডিসিভিত্তিক সুবিধাগুলো উঠে যাওয়ার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে বর্তমান সরকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এরই আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি ‘সেপা’ নামে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
ইতোমধ্যে এ বিষয়ে যৌথ সমীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছে। সেপা চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পণ্য-সেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সের মতো অনেক বিষয়। এ চুক্তি হলে উভয় দেশের বাণিজ্য আরও বাড়বে এবং বিনিয়োগের দরজা উন্মুক্ত হবে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘সমৃদ্ধির জন্য আন্তঃযোগাযোগ: দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলের সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা চালুর চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের হয় মাত্র ১ শতাংশ। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে ১৮২ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বাড়বে ১২৬ শতাংশ। আর নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন ব্যবস্থা চালু হলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে ২৯৭ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি বাড়বে ১৭২ শতাংশ। সার্বিক পর্যালোচনায় এটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, শুধু বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ হিসেবে নয়; নানামুখী প্রয়োজনীয় সম্পর্কের গভীরতায় দুই দেশের সরকার ও জনগণের মেলবন্ধন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথকেই প্রশস্ত করেছে। ব্যক্তি-দলীয় স্বার্থে কারও মান-অভিমান বা ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ বাচনিক ভঙ্গিতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। বাস্তবতা বিবর্জিত কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতি আপামর জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়