ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ২ মার্চ ২০২৪

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ড

রাজধানীর বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে আগুন

রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরাইল-ফিলিস্তিনি যুদ্ধে বিশ্বকে এক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তা নিয়ে সরকার সতর্ক রয়েছে। জীবন-জীবিকার চাকা সচল রাখার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। তারই মধ্যে যুক্ত হয়েছে আরেক সংকট আগুন দুর্ঘটনা এবং যা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে অভিহিত হয়েছে।

রাজধানীর বেইলি রোডে একটি বহুতল ভবনে আগুনে অন্তত ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। যা খুবই দুঃখজনক। এটি একটি এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। এসব মৃত্যু আমাদের জন্য বেদনাদায়ক ও অনাকাক্সিক্ষত। সমগ্র জাতি আজ শোকাহত। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 
অতীতে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে বিএম কনটেনার ডিপোতে অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ৩০ জন। ওই ঘটনায় দগ্ধসহ আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। আগুন নেভানোর কোনো সরঞ্জাম ছিল না মনে হয়। এটা কর্তৃপক্ষের অনেক বড় অবহেলা। এই অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দায়িত্ব অবহেলাকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে এটাই হলো জনগণের দাবি।  
২০২১ সালের ৮ জুলাই বিকেলে রূপগঞ্জ এলাকায় হাশেম গ্রুপের জুস তৈরির এক কারখানায় ভয়াবহ আগুন দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় ৫২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহতদের স্বজনকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করেছিল, অধিকাংশ শ্রমিকের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ছয়তলাবিশিষ্ট ওই কারখানার কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা জীবন বাঁচাতে দৌড়াদৌড়ি করেও শেষ রক্ষা হয়নি। কি কষ্টদায়ক মানুষের মৃত্যু! এ রকম দুর্ঘটনা প্রায় ঘটতে দেখা যায়।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার চুরিহাট্টা, নিমতলীসহ অনেক স্থানে বারবার আগুন দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। যাদের পরিবারে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তারাই বুঝতে পারে কি কষ্ট বহন করতে হয়! নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবারের মূল কর্তা বা আয়ের মূল ব্যক্তি ছিলেন। একবার চিন্তা করুন, কিভাবে তাদের পরিবার সংসার চালাবে! 
যেসব ভবনে দুর্ঘটনা ঘটছে সেগুলোর কাঠামো ঠিক আছে কিনা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ কিনা, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীদল আছে কিনা সেসব এখন বড় প্রশ্ন। কারণ, এসবের যথাযথ তদারকির দুর্বলতার কারণেই এ ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। কোথাও শ্রমিকরা বা সাধারণ মানুষ নিরাপদ নয়। ইতোপূর্বে সংঘটিত আগুন দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় একের পর এক এই দুর্ঘটনা ঘটছে। অগ্নিকা-ের ঘটনায় অনেক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

অনেক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পেলেও বিচার কার্যক্রম নানা প্রতিবন্ধকতায় আটকে যায়। যে কারণে এসব দুর্ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে। যা আমাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। কারখানা বা ভবনে যেখানে শ্রমিকরা কাজ করবে তা নিয়ে ভয় রয়েছে যে, আবার কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়। তাই মানুষকে নিরাপদে কাজ করার ব্যবস্থা করুন।  
কর্তৃপক্ষের অবহেলা বা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বাবা-মা হারাল তাদের প্রিয় সন্তানকে এবং পরিবার হারাল তাদের প্রিয়জনকে। তারা আর কোনো দিন ফিরে পাবে না তাদের প্রিয় মানুষকে। আমরা সাধারণ মানুষ এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটুক তা চাই না। তাই সরকারকে অনুরোধ করব, আইন প্রয়োগ করতে আরও কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। জনগণ সরকারের সঙ্গে আছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, যাতে শ্রমিকরা নিরাপদে কাজ করতে পারে। এছাড়াও কর্তৃপক্ষকে আইন সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। 
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে অগ্নিদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার তিনশত সতেরো জন এবং আহত হয়েছে বারো হাজার তিনশত চুয়াত্তর জন। সময়ের পরিবর্তনে অগ্নিদুর্ঘটনা তার ধরন ও স্থান পরিবর্তন করেছে। আমাদের দেশে অতীতে গ্রামাঞ্চলে আগুন লাগত প্রায়ই। কোনো এলাকায় আগুন লাগলে বাড়ির পর বাড়ি পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। গ্রামের সেই আগুন এখন শহর-বন্দর, শিল্প-বাণিজ্যিক কারখানায় ঘটে চলছে।

এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে- কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ে ঘাটতি, অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ, আইনের দুর্বলতা, শ্রমিকের অসচেতনতা, শ্রমিকের সতর্কতার অভাব, অধিক মুনাফার আশায় কম ক্ষমতাসম্পন্ন আগুন নিভানো যন্ত্র ব্যবহার, ফিটনেসবিহীন মেশিনারি, আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও সহজেই জামিনে বের হওয়া এবং মালিকপক্ষের সঠিকভাবে নিয়মকানুন মেনে না চলা ইত্যাদি। এছাড়া এসব দুর্ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। 
যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমরা সবাই খুবই তৎপর থাকি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় ঘটনা এবং বিচার কার্যক্রম হারিয়ে যায়। অতীতে আগুন দুর্ঘটনায় অনেক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। অনেক দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে এবং কমিটি কয়েকজন অপরাধীকে শনাক্ত করার পাশাপাশি সুপারিশও দাখিল করে। যার কোনোটিই বাস্তবায়ন বা কার্যকর হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

অপরাধীদের যথাযথ বিচার তো হয়ই না, বরং দুর্ঘটনাকবলিত ভবনগুলো সামান্য মেরামত বা সংস্কার করে আবারও চালাতে দেখা যায়। এছাড়া শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতির ফিটনেস সনদ, নিবন্ধন ও শ্রমিকদের নিয়োগের ব্যবস্থার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। যারা নিহত বা আহত হয়েছে, তাদের পরিবারকে পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে সরকার বা ভবনের মালিককে। জনগণের প্রত্যাশা হলো, বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা। 
আইনের দুর্বলতার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করে অল্পতেই আবার মুক্তি পেয়ে যায়। তাই তারা এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও ভয় পায় না। ভবন বা কারখানা তৈরির বিধি সংশোধন করে নতুন যুগোপযোগী আইন করা প্রয়োজন, যাতে এই দুর্ঘটনা আর না ঘটে। নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ হওয়া উচিত।

এছাড়াও দুর্ঘটনা রোধে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকতর সচেতন ও সতর্ক থাকা, কর্তৃপক্ষের তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থা বৃদ্ধি, সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি সব সুউচ্চ ভবন ও কারখানায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কার্যকরী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা খুবই প্রয়োজন। সর্বোপরি, জাতীয় জরুরি সেবা- ৯৯৯ আরও বেশি কার্যকর করা এবং এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, 
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×