ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

দূরাগত হাওয়া ॥ দুজন কবির কাব্য

সরকার মাসুদ

প্রকাশিত: ২২:২৬, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

দূরাগত হাওয়া ॥ দুজন কবির কাব্য

দুজন কবির কাব্য

প্রান্তিক জনপদের নিম্নবর্ণের মানুষজনও তাদের সমাজ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত তার গল্পে। একাধিক মাঝারিমানের উপন্যাসও লিখেছেন। কিছুকাল আগে এ লেখক আবির্ভূত হয়েছেন কবি হিসেবে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতে দুটি শিশু’ নামে তার একটি পুস্তিকা বেরিয়েছে ২০০২ সালে। এক ফর্মার চটি বই ধারণ করেছে তেরোটি কবিতা

প্রধানত কবি কিন্তু কথাসহিত্যের নজরকাড়া সামর্থ্যরে প্রমাণ রেখেছেন অথবা কথাসাহিত্যিক হিসেবে সুপরিচিত কিন্তু কাব্যক্ষেত্রেও উল্লেখ সক্ষমতা দেখিয়েছেন এমন লেখক আমাদের দেশে খুব বেশি নেই। আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আলাউদ্দীন আল আজাদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত কবি যখন কথা সাহিত্যিকরূপে আবির্ভূত   
হন অথবা কথাসাহিত্যিক কবিরূপে তখন আমার ধারণা, তার সাহিত্যকর্মের বিচার সাধারণত সুবিবেচনা পায় না, অন্তত বাংলাদেশে। এমনটাই দেখে আসছি বহুকাল। এখানে, দুর্ভাগ্যবশত ‘কবির লেখা গল্প’; ‘গল্পকারের লেখা কবিতা’ কথাগুলো চালু হয়েছে। এবং এ ধরনের কথাবার্তা, আমি নিশ্চিত লেখকের সাহিত্যবিচারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে। আমি মনে করি, একজন কবি যখন একটি ছোট গল্প/উপন্যাস লেখেন সে সময় তিনি কথাসাহিত্যিক কেননা তার কথাসাহিতিক সত্তাটিই ওইসময় সক্রিয়।

একইভাবে একজন কথাসাহিত্যিক যখন কবিতা রচনা করেন সে মুহূর্তে তিনি কবি। কিন্তু আমাদের এখানে পাঠঅনীহ ও ভ্রান্তচিন্তাচালিত লোকজনকে কারও প্রসঙ্গে ‘উনি তো কবি’; কিংবা ‘উনি আসলে কথাসাহিত্যিক!’ ধরনের মন্তব্য করতে শুনেছি অনেকবার। যেন একজন কথাসাহিত্যিকের মানসম্পন্ন কবিতা লেখার বা একজন কবির উৎকৃষ্টমানের গল্প/উপন্যাস লেখার সামর্থ্য নেই।
সম্প্রতি দুজন লেখকের দুটি কাব্যগ্রন্থ পড়ার র্প ওপরের কথাগুলো মনে হয়েছে আমার। বাংলাদেশের আধুনিক কথাসাহিত্য সম্বন্ধে জানাশোনা আছে এবং সারাদেশের সৃজনশীল লেখালেখির কম-বেশি খোঁজ-খবর রাখেন এমন পাঠকের কাছে রাজা সহিদুল আসলাম (১৯৬৪) নামটি অপরিচিত নয়। একনিষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের কাছেই নয় শুধু, সামগ্রীকভাবে কথাসাহিত্য বিষয়ে উৎসুক পাঠকবর্গের একটি অংশের কাছে রাজার পরিচয় সুস্পষ্ট।

সাহিত্য সম্পাদনার বেলায় যেমন (‘চালচিত্র’-নামে একটি মানসম্পন্ন সাহিত্যপত্র তিনি প্রকাশ করছেন ছত্রিশ বছর যাবত), তেমনি লেখকতা জীবনের গোড়া থেকেই রাজা শহিদুল আসলাম ভিন্ন রুচির স্বাক্ষর রেখে আসছেন। ছোট গল্পে তিনি স্বাতন্ত্র্যপ্রয়াসী ও হৃদয়গ্রাহী। প্রান্তিক জনপদের নিম্নবর্ণের মানুষজনও তাদের সমাজ দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত তার গল্পে। একাধিক মাঝারিমানের উপন্যাসও লিখেছেন। কিছুকাল আগে এ লেখক আবির্ভূত হয়েছেন কবি হিসেবে।

‘বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতে দুটি শিশু’ নামে তার একটি পুস্তিকা বেরিয়েছে ২০০২ সালে। এক ফর্মার চটি বই ধারণ করেছে তেরোটি কবিতা। এটা হাতে নেওয়ার পর আমার মনে পড়েছিল ওয়ালেস স্টিভেন্সকে। জগতখ্যাত এ মার্কিন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঊরমযঃববহ চড়বসং বেরোয় যখন তার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রাজার পুস্তিকাটি বেরিয়েছে সাতান্ন বছর বয়সে। গ্রন্থের প্রকাশকাল প্রধান বিবেচ্য বিষয় নয়।

ভেতরে কী আছে সেটাই আসল। কয়েকটা কবিতা পড়ার পর মনে হয়েছে, বেশ দেরিতে প্রকাশ পেলেও রাজা এলে-তলে কাব্যচর্চা করছেন অনেকদিন ধরেই। এটা হওয়া অসম্ভব নয় যে তিনি গোড়ার দিকে কবিতা লিখেছেন, মাঝখানে গদ্যের চাপে কাব্যচর্চা স্থগিত ছিল বহুকাল; এখন আবার শুরু হয়েছে। তো ওই ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের বিপরীতে দুটি শিশুর সবগুলো কবিতা আমি নিবিষ্টচিত্তে পড়েছি। মনে হয়েছে, তিনি যা লিখছেন সে বিষয়ে তার ধারণা স্বচ্ছ।

উপজীব্য সম্বন্ধে অস্পষ্টতা না থাকায় এবং যোগাযোগ সক্ষম এক কাব্য ভাষায় তা উপস্থাপিত হওয়ায় কবিতাসমূহ আমাকে স্পর্শ করেছে। গল্পে যেমন তিনি জটিল নন, ‘সহজ’-এর ভেতরেই শিল্প সন্ধানী, তেমনি কবিতার ক্ষেত্রেও তা-ই। আধুনিক কাব্য শিল্প অন্বেষণের ফাঁপড়ে পড়ে অনেক অস্বচ্ছতা ও জটিলতার জন্ম দিয়েছে, দিয়ে চলেছে। রাজার কবিতা ওই দোষ থেকে মুক্ত। সহজ সরল ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন। কথা কম বলেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেই কথা অভিঘাতী হয়ে উঠতে পেরেছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি পঙ্ক্তি হাজির করছিÑ ‘বৃক্ষ, তুমি আমার লেখার টেবিল হয়েছো/তোমার ভীষণ নীরবতা আমাকে পীড়া দেয়/ ধরো এই খাতা পেন্সিল কালির দোয়াত/তোমার পত্র-পল্লব আর এই আমি তোমার হলুদ পাখি/ধরো এই ড্রয়ার দুটো লীনেট পাখির বাসা/যারা ভুল করে গ্রীষ্মে এক বাসা বেঁধেছিল এসে।’ (বৃক্ষ, পৃ: ৮) কথাসাহিত্যি করা ‘বাস্তব’-এর কারিগর। গল্প-উপন্যাসে স্বপ্ন বা স্বপ্ন-কল্পনা আসতেই পারে। কিন্তু তা যদি আসেও, সেটা আসে ওই বাস্তবের রূঢ়তার পথ ধরেই।

একজন কথাকার যদি একই সঙ্গে কবিও তাহলে বুঝতে হবে তিনি স্বপ্ন-কল্পনারও কারবারি। সেজন্য দেখা যাচ্ছে যে ‘কালির দোয়াত’ এখন বাস্তবে অনুপস্থিত সেটাই উপস্থিত হয়েছে রাজার কাব্যে। কেননা ওই দোয়াত আছে তার মাথার ভেতর। সব সময় অর্থসন্ধান, বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে, কোনো কাজের কথা নয়। বিশেষ কোনো মানে নেই, কিন্তু শব্দাশ্রিত চিত্র/চিত্রকল্প বা ধ্বনিব্যঞ্জনা কিংবা মর্মগ্রাহী দৃশ্য বর্ণনার কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে এমন অসংখ্য কবিতার কথা আমরা জানি।

রূপকথায় জীবজন্তু বা বস্তু কথা বলে, গল্পের গরজেই। রাজার কবিতায় দেখতে পাচ্ছি ঘাষ কথা বলছে কাটিং ম্যানের সঙ্গে। ঘাসের মুখে মানুষ শোভন কথা আর ওই ঘাসের অস্তিত্বের বাস্তবতাÑ দুয়ে মিলে অনবদ্য হয়ে উঠেছে ‘ঘাষ ও কাটিং ম্যান’ কবিতাটি। আকারে ছোট কিন্তু ভাবের দিক থেকে বড় এ কবি তার পুরোটাই শেয়ার করছি পাঠকের সঙ্গেÑ ‘আমাকে তুমি যতই ছেঁটে ফেলো/ আমি ঠিক একটু অবসরে বেড়ে উঠবো জেনো/আমার অনন্তকাল বেড়ে ওঠা/তুমি থামিয়ে রাখতে পারবে না কখনো/আমার অন্তর আর বহিরঙ্গের আভা/থাকবে অটুট, জেনো কাটিংম্যান/শুধু শুধু ক্লান্ত হবে তুমি।’

লক্ষ্য করুন, ঘাষ এখানে বলছে ‘আমার অন্তর আর বহিরঙ্গের আভা থাকবে অটুট।’ আসলে তো এ লেখকেরই কল্পনা। এ জাতীয় ভাব-কল্পনা কবিতা নামের টেক্সটকে শক্তিমন্ত করে তোলে। আধুনিক কবিতা এমন এক শিল্প যা আভাস ইঙ্গিত ও প্রতীকের জুতসই প্রয়োগের ভেতর দিয়ে তার অনন্যতা জাহির করে। ব্যক্তিক্রমী বিষয়বস্তুকে যোগাযোগসক্ষম কিন্তু আড়াল প্রিয় কাব্য ভাষায় উপস্থাপন করতে পারলে সেই কাব্য অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

রাজা যখন তার লেখার টেবিলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তুমি আমার বৃক্ষ, আজ থেকে তুমি আমার সবুজ বৃক্ষ’ তখন ভাবি, উল্লিখিত আড়াল প্রিয়তাই অন্যভাবে নিজত্বময় অন্যভঙ্গিতে আকার লাভ করেছে। আমি আশাবাদী, নবাগত এ কবি কবিতার অর্জনের পথে অনেক দূর এগোতে পারবেন যদি না তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বা অন্যবিধ কারণে তার কাব্যচর্চায় দীর্ঘস্থায়ী ছেদ পড়ে।
স্কুল শিক্ষকতার মতো চাপযুক্ত পেশায় থেকেও যে নিরবচ্ছিন্ন কাব্যচর্চা সম্ভব, সেটা করে দেখিয়েছেন রাজ্জাক দুলাল (১৯৬৯, দেবিগঞ্জ, পঞ্চগড়)। বহু বছর ধরে ছোটদের কবিতা-গল্প লেখার পর তিনি বড়দের উপযোগী সাহিত্যে মনোনিবেশ করেছেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অন্ধ জোনাকি’ বেরিয়েছে ২০১৯ সালে। রাজ্জাকের কিশোর কবিতাও আমি পড়েছি। শিশুতোষ রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ও সাবলীল। তার ‘মৌন বাঁশির নকশা’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল অক্টোবর ২০২২।
পাঠক হিসেবে আমার পছন্দ সহজ কবিতা; সহজ কিন্তু সংকেতী। অস্পষ্টতা আধুনিক কাব্যের এক উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য। আবার ওই অস্পষ্টতাই একটি কবিতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। পুরো ব্যাপারটা নির্ভর করছে লেখকের ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর। রাজ্জাক দুলাল, বোধকরি, স্বচ্ছতার পক্ষে। তার কাব্যের সহজ ও সাবলীল ভঙ্গি আমার ভালো লেগেছে।

বর্ণনাধর্মিতা তার কবি তার উল্লেখযোগ্য দিক। অন্য বৈশিষ্ট্যও আছে। সহজ ভাষা থাকলেই যে তা পড়তে ভালো লাগবে এমন নয়। দুলালের কবিতার ভাষা কেবল সহজ নয়, আমাদের তা ছুঁয়েও যায়। তার কোনো কোনো কবিতা আমার ভাবনার খোরাক হয়েছে, কোনো কোনোটি তেমন ভালো লাগেনি। চিত্তস্পর্শী বর্ণনা ও ভাষাজনিত সারল্য যখন একত্র হয় তখন একজন লেখক কবিতা সৃষ্টির পথে অনেকখানি এগিয়ে থাকেন। ‘রাতের পাগল’, ‘বাবার রায়’ প্রভৃতি কবিতায় সেই এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার।

‘বাবার রায়’-এ আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? ছেলে বলছে, সে ডাক্তার হবে; ইঞ্জিনিয়ার হবে; উকিল হবে, পাইলট হবে ইত্যাদি। সব শুনে স্বল্পভাষী বাবা হাসলেন এবং বললেন ‘মানুষ হও’। এটা নতুন কথা নয়। এ গল্প আমরা জানি। কিন্তু কবিতাটা ভালো রচনা হয়েছে তার উপস্থাপনের গুণে, সহজ ও অনবদ্য ভাষারীতির কারণে। এ লেখার প্রথম দিকেই দুলাল বাবা সম্বন্ধে বলছেনÑ ‘তার হৃদয় দ্যাখে চোখের চেয়েও বেশি।’ এরকম পঙ্ক্তি ধারণ করেই একটা লেখা কবিতা হয়ে ওঠে।
কিভাবে বলা হচ্ছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কবিতার ক্ষেত্রে। বলার ধরনই নির্ণয় করে দেয় কবির দক্ষতা কতখানি। ‘রাতের পাগল’ কবিতার শুরুতেই বলা হয়েছে ‘রাত এসে ধরা দেয় চোখে।’ একই স্তবকের শেষ দিকে লেখক বলছেনÑ ‘দরজাটা খোলা থাকে জানালার কোণে।’ একটু অন্যরকম লাগে। তবে এ কবিতা উন্নত স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে তৃতীয় স্তবকে এসে। এখানে কবি বলছেনÑ ‘উদ্ভট রাত্রি খুলেছে কাপড়/ কতবার চোখ ঢাকি অবুঝ হাতে/একটা সোনালি টিপ জ্বলজ্বল করে/ ও বাড়ির মন্দিরা রাতের পাগল।’
ব্যক্তিজীবনে রাজ্জাক দুলাল ঠাকুরগাঁওয়ের সোনাহার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। পেশা শিক্ষকতা, নেশা লেখকতা। লেখার ওপর পেশার ছায়া পড়তেই পারে। পড়েছে দুলালের বেলাতেও। ‘আহার নিদ্রা’ শিরোনামের কবিতাটি তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এখানে লেখক বলছেনÑ ‘সাপটি মরেছে ভেবে/সাহস করে একটি ব্যাঙ বর্ষার গান ধরে/ব্যাঙটি সাপের পেটে সাঁতার কাটে/ভাজ্য মিলে যায় ভাগশেষ থাকে না।’
রাজ্জাক দুলাল রচিত ছড়ার বই ছয়টি। কাব্যগ্রন্থ দুটি। প্রাথমিক সাফল্য বলতে যা বুঝায় সেটা রাজ্জাক অর্জন করেছেন। কিন্তু কবিতার পথ বড় পিচ্ছিল। কবিতা তার স্রষ্টার কাছে অনেক বেশি সময় ও মনোযোগ দাবি করে। এ নবাগত কবি আগেই বলেছি, হেড মাস্টার। যদি সাহিত্যের জন্য প্রয়োজনীয় অবসর তিনি পান এবং সেই সঙ্গে ১৯৪০ পরবর্তী আধুনিক কবিতার বিচিত্র ধরন সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা নিতে পারেন তাহলে আমার বিশ্বাস, আট/দশ বছর পর তিনি কবি হিসেবে নিজেকে সেই জায়গায় দেখতে পারেন যা কবি যশোপ্রার্থী লেখক মাত্রেরই কাম্য।

×