ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম

রমজানুল মোবারকে ওমরাহ পালন

মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২০:৪৬, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

রমজানুল মোবারকে ওমরাহ পালন

প্রসঙ্গ ইসলাম

ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি হলো পবিত্র হজ সম্পাদন করা। ধর্মীয় ও আর্থিকভাবে পূর্ণতা আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন মুসলমান জীবনের এ মহা মূল্যবান ইবাদত ও সফর সম্পন্ন করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পবিত্র হজের কথা আসার সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ে পবিত্র ওমরাহ পালনের কথাও। হজের সঙ্গে উমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একবার হজে গেলে এমনিতেই একাধিক উমরা করতে হয়। ওমরাহ পালন হজকে পূর্ণতা ও বিশুদ্ধতা দেয়। এতদসত্ত্বেও ওমরাহ নফল ইবাদত আর হজ ফরজ ইবাদত।

আবার হজের পাশাপাশি পবিত্র খানায়ে ক্বাবা জিয়ারতকেন্দ্রিক ওমরাহ একটি আলাদা ও কাক্সিক্ষত ইবাদতও বটে। এজন্য অনেক মুসলমানকে দেখা যায় সুযোগ পেলে নিজের জীবনের ফরজ হজ আদায়ের পূর্বে ওমরাহ করার জন্য আমাদের দেশ থেকে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেন। পবিত্র হজের হৃদয়কাড়া অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পর পবিত্র হারামাইন শরীফাইনের মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করার পর অনেক হাজীকে পরবর্তীতে বারবার, প্রায় বছর ওমরায় গমন করতে দেখা যায়।

সুযোগ ও তৌফিক থাকলে এ ধরনের হজ ও ওমরাহ জীবনে বারবার পালনের উৎসাহও রয়েছে হাদিস ও পুণ্যাত্মা মনীষীদের জীবনে। এক বর্ণনায় নবীজী (সা.) আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরকে নির্দেশ দিলেন যেন আয়েশাকে (রা.) তানঈম থেকে ওমরাহ করানোর ব্যবস্থা করে। মুহাররাশ আল কাবীর বর্ণনায় রয়েছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) এক রাতে জুরানা থেকে ওমরাহর নিয়তে বের হয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন।

সব মিলিয়ে পবিত্র ওমরাহ পালন বিশেষত মাহে রমজানে ওমরাহ ও যিয়ারতের বড় ধরনের ফজিলত ও আত্মতুষ্টির বিষয় রয়েছে। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘কেউ যদি মাহে রমজানে ওমরাহ্ পালন করে সে যেন আমি নবীর সঙ্গেই হজ করল।’ মাশা আল্লাহ ! কত উচ্চাঙ্গের সুসংবাদ। একটি ওমরাহ যার মর্যাদা- স্বয়ং নবীজীর সঙ্গে হজ করার মতো।

উল্লেখ্য, ওমরাহ মানে পবিত্র ইহরামের কাপড় পরিহিত অবস্থায় আল্লাহর ঘরের তাওয়াফ করা এবং তৎপরবর্তী ছাফা ও মারওয়ায় সাঈ করে মাথা মুন্ডন করা। ওমরাহ পালনের জন্য ওমরাহযাত্রী যদি প্রথম মক্কা শরীফ গমন করেন তবে তাকে জেদ্দায় ঢোকার আগের বিমানবন্দর থেকে ইহরাম পরিধানপূর্বক বিমানে উঠতে হবে।

ইহ্রাম বাঁধার পূর্বে নখ, চুল, গোঁফ ইত্যাদি যা প্রয়োজন কেটে সাবান দিয়ে ভালোভাবে গোসল করে পাক পবিত্র হয়ে ওজু করে (অসুস্থ থাকলে শুধু ওজু করে) সুগদ্ধি মেখে পুরুষদের সেলাইবিহীন দুই খানা সাদা কাপড় (৫ বা ৬ হাত লম্বা, আড়াই হাত প্রস্থ), একখানা কাপড় পরিধান করে এর একখানা কাপড় গায়ে জড়িয়ে দুই কাঁধ ও পিঠ ঢেকে (মেয়েরা পর্দার জন্য প্রয়োজনীয় কাপড়সহ সেলাই করা কাপড় পরে) ২ রাকাত সুন্নাতুল ইহ্রাম নামাজ পড়তে হবে।

ইহ্রামের প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা কাফেরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা এখ্লাছ কিংবা নিজের জানা মতো বিশুদ্ধ সুরা পাঠ করে নামাজ শেষ করতঃ ওমরাহ্র নিয়ত করতে হবে। এখন ইহ্রাম বাঁধা হয়ে গেল। এ নিয়তের পর ৩ বার তাল্বিয়াহ্ পড়তে হবে। এরপর পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ করা ও সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ীর সময় ছাড়া ওমরাহ শেষ হওয়া পর্যন্ত মাঝে মাঝে তাল্বিয়াহ্ পড়া ইহ্রামের প্রধান কাজ। 
ইহ্রাম অবস্থায় বর্জনীয় : পুরুষের জন্য সেলাইকৃত কাপড় পরিধান/শরীর হতে পশম পরিষ্কার করা/ নখ কাটা ইত্যাদি। 
সুন্নাতুল ইহ্রামের নিয়ত : নাওইতুয়ান উছাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকাতায় ছালাতিল সুন্নতুল ইহ্রাম, মাতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল ক্বায়াবাতিশ্ শারিফাতে আল্লাহু আকবার। অর্থাৎ, আমি আল্লাহর ওয়াস্তে পবিত্র ক্বাবা শরিফের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সুন্নতুল্ ইহ্রামের ২ রাকাত নামাজ পড়ছি আল্লাহু আকবার।
তাল্বিয়াহ্ : লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক, লাব্বায়েকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়েক, ইন্নাল্ হাম্দা ওয়ান্ নিয়মাতা লাকা, ওয়াল মুল্ক লা শারিকা লাক্। অর্থাৎ : ইয়া আল্লাহ্, হাজির হয়েছি তোমার দরবারে, হে আল্লাহ্ তোমার গোলাম উপস্থিত। তোমার কোন শরীক নেই, নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামতরাশি সবই শুধু তোমারই এবং সারা বিশ্বের একচ্ছত্র রাজত্ব তোমারই। বিন্দু মাত্র কোথাও তোমার শরীক নেই। 
ওমরাহ্ এর নিয়ত : আল্লাহুম্মা ইন্নি ঊরিদুল ওম্রাতা ফাইয়াছ্ছির হা লী ওয়া তাকাব্বাল্ হা মিন্নী। অর্থাৎ : ‘আল্লাহ্, আমি, তোমার উদ্দেশ্যে ওমরাহ করার নিয়ত করছি, তুমি আমার জন্য ইহা সহজ করে দাও এবং ইহা কবুল কর।’ ওমরাহ্ এর ফরজ দুটি : (১) ইহ্রাম বাঁধা, (২) পবিত্র ক্বাবা শরীফ তাওয়াফ করা। ওমরাহ্ এর ওয়াজিব দুটি : (১) সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করা, (২) মাথা মুন্ডন করা বা চুল ছোট করা।
চলুন তাহলে একজন ওমরাহকারীর জন্য আরও কিছু ধারাবাহিক কাজ শেয়ার করি। জেদ্দা বিমানবন্দরে অন্যদের আগে আগে নামার চেষ্টা করুন। এখানে বেশ লম্বা কাজ রয়েছে। সামনের লোকদের ফলো করুন। সবশেষ বাংলাদেশী পতাকা অনুসরণ করে বাংলাদেশী ওয়েটিংস্থলে অপেক্ষা করুন এবং সামনে গাড়িতে করে যাত্রা সম্পর্কে বাংলাদেশ হজ মিশনের পোশাকধারী ভাইদের জিজ্ঞেস করুন।

তারা আপনাদের মুয়াল্লিমের গাড়িতে সোপর্দ করবেন। ঐ গাড়িতে করে নির্দিষ্ট হোটেলে যেতে হবে। অথবা তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে নিজেরা পছন্দ ও সামর্থমতো ২/১ দিনের জন্য      মিসফালাহ ইবরাহীম খলীল রোডে জাবালে উমর থেকে বর্তমান এশিয়া হোটেলের ধারেকাছে রুম ভাড়া করুন। (কিংবা বাদশাহর বাড়ির পাশে মেরিডিয়াম হোটেলের আশপাশে থাকার চিন্তা করুন)। সমস্যা হলে কাছে অন্য হোটেল দেখুন।

সেখানে প্রায় হোটেল বাংলাদেশী লোকজন দেখাশোনা করে, অসুবিধা নেই। জিজ্ঞেস করলে নিকটেই পেয়ে যাবেন বাংলাদেশী খাওয়ার হোটেল। হারাম শরীফ থেকে আসা যাওয়ার পথে খাবার কিনে নিজেদের রুমে খেতে পারবেন। হোটেলে পৌঁছার পর কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম করুন। খবরদার, ইহরামের কাপড় খুলবেন না। একটু সুস্থ মনে হলে নারী পুরুষ সবাই মিলে আপনাদের সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ওমরাহ করতে বের হন। হজ পালন হোক কিংবা ওমরাহÑ একজন অভিজ্ঞ বন্ধু আলেম হলে সফরের ধারাবাহিকতা রক্ষায় এবং ইবাদতের পূর্ণতায় কোন শঙ্কা থাকে না। 
ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে মসজিদে হারাম দেখলে মসজিদে প্রবেশের দুআ পড়–ন। জুতাগুলো জুতার থলে অথবা বুকের থলেতে নিন। বাদশাহ আবদুল আজিজ ১নং গেট দিয়ে প্রবেশ করুন। মনে রাখবেন ভারী কোনো থলে নিয়ে গেলে পুলিশ আপনাকে তোয়াফের জন্য ঢুকতে দেবে না। মসজিদে সামান্য নামলেই দেখবেন আল্লাহর কালো ঘর। আস্তে আস্তে এর পাশের ময়দান বা মাতাফে নামুন। এরপর অন্যদের দেখাদেখি পাশের দেয়ালে সবুজ চিহ্নিত রেখাটি আবিষ্কার করুন।

সেখানে পৌঁছে আল্লাহর নাম নিয়ে অন্যদের দেখাদেখি তাওয়াফ শুরু করুন। একে একে সাত চক্কর। এ সময় হজ গাইডে লিখিত তাওয়াফের দুআগুলো পড়তে পারেন অথবা নিত্য যেসব দুআ আমরা দেশে নামাজ কালামে পড়ি তা পড়তে পারেন। কিংবা নিজ ভাষায় আল্লাহকে গুনাহ মাফির জন্য বলতে পারেন। 
ওমরাহ্ করার ক্ষেত্রে বিশেষ কয়েকটি দিক-
(১) পবিত্র ক্বাবা শরীফ তাওয়াফ করা। 
(২) আল্লাহর ঘরের দরজা ও মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে নিরাপদ দূরত্বে ২ রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করা, আরবী নিয়তের দরকার নেই।
(৩) জমজমের পানি খুব ঠা-া বিধায় অল্পই গ্রহণ করুন। এরপর সায়ী শেষ করে মসজিদে হারামের যেসব জারের মধ্যে সবুজ রঙে ‘নট কোল্ড’ লেখা আছে সেখান থেকে ইচ্ছামতো পান করুন। প্রয়োজনে কাঁধের থলেতে ছোট  বোতল রেখে পানি বাসার জন্য নিয়ে আসুন। জমজমের পানি দুনিয়াবাসীর জন্য এক বড় নিয়ামত ও নিরাময়। আমরা দেশে অন্য হাজী ও ওমরাকারী থেকে সামান্য জমজমের পানির জন্য ধর্ণা দেই।

অথচ হারাম শরীফ থেকে পানি বহন করে হোটেলে এনে প্রাণ ভরে জমজম খাওয়ার মানসিকতা ভুলে যাই। যাই হোক, জমজমের পানি পান করার সময় বলুন : ‘আল্লাহ এ পানির বরকতে আমার রিজক বৃদ্ধি করে দাও। অসুখ বিসুখ দূর করে দাও আর জ্ঞান বাড়িয়ে দাও।’ 
(৪) এরপর সায়ী বা দৌড়ানোর জন্য সাফা পাহাড়ের স্থানে যান। হজের বই থেকে নির্দিষ্ট দুআ পড়তে পড়তে অথবা মনের আকুতি জানিয়ে মারওয়া পাহাড়ের দিকে যান। এভাবে এক চক্কর। আবার সাফা পাহাড়ে আসুন। দুই চক্কর। এভাবে সাত চক্কর দিন। মাঝখানে সবুজ রেখা বরাবর একটু  বেশি দৌড়ানোর চেষ্টা করবেন। সবশেষ মারওয়া পাহাড়ে দাঁড়িয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে নিজের জন্য প্রিয়জনদের জন্য দুআ করুন। মা হাজেরার মতো। 
ওমরাহর সবশেষ ওয়াজিব কাজ মাথা মুন্ডন করে বা চুল ছোট করে স্বাভাবিক হওয়া। এজন্য হোটেলে আসার সময় একটি সেলুনে প্রবেশ করুন ১০/১২ রিয়াল দিয়ে চুল কাটুন। সঙ্গে মহিলা গেলে বাসায় ইঞ্চি পরিমাণ তার চুল কাটতে হবে। এরপর গোসল সেরে স্বাভাবিক পোশাক পরুন। বিশ্রাম করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন, প্রয়োজনে এদিক-ওদিক বেড়ান। একা সফর করবেন না, বাংলাদেশী অথবা ইন্ডিয়ান ড্রাইভারের গাড়িতে উঠুন।

আরবদের গাড়িতে উঠবেন না। তাদের সঙ্গে দরদাম ও ভাষাগত সমস্যা হতে পারে। আরবদের গাড়িতে উঠতে হয় জেদ্দা ও মদীনা সফরের সময়। পরিশেষে আল্লাহর ঘরের মেহমানদের দুনিয়া আখিরাতের কল্যাণ কামনা করি। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)।

 লেখক :  অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

[email protected]

×