ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বিশ্ব ‘বই প্রদান’ দিবস

কাজী সুলতানা শিমি

প্রকাশিত: ১৭:২৬, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বিশ্ব ‘বই প্রদান’ দিবস

বই উপহার

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বই বিতরণ/প্রদান দিবস (International Book Giving Day) ২০১২ সাল থেকে এই দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়ে আসলেও এখনো অনেকেই জানি না বা উৎসব করে পালন করি না। যুক্তরাজ্যর এ্যমি ব্রডম্যুর শিশু-কিশোরদের  বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির ভাবনা থেকে এই দিবসটি প্রবর্তন করতে সচেষ্ট হন। 

পরস্পরকে বই উপহার দেয়া, কোন প্রতিষ্ঠান বা মানুষকে বই দান এবং বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ সৃষ্টি করাই এ দিনটির মূল লক্ষ্য। এখনো যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সাউথ আফ্রিকা সহ চৌচল্লিশটি দেশে বর্তমানে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে।    

নিজের বই প্রকাশের পর, বই এর প্রতি সাধারণ মানুষের অনাগ্রহের কথা জানতে পারি প্রত্যক্ষভাবে। বইপ্রেমীদের কথা অবশ্য আলাদা। যেমন, ফেব্রুয়ারি এলে বিক্রেতা ও প্রকাশক খুব আক্ষেপ করে জানান আজকাল কেউ আর বই পড়ে না তাই বই কিনেও না। বই বিক্রি যা একটু হয় একুশের বইমেলা এলে। সারাবছর বই গুলো পরে থাকে তাকে তাকে, সারিতে সারিতে সাজানো কিংবা আড়তের গুদাম ঘরে। 

ঈদের মতো ফেব্রুয়ারি মাসের অপেক্ষায় থাকে প্রকাশকরা। তখন নতুন কিংবা প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই প্রকাশ হলে নতুন বইয়ের সাথে পুরাতন বই গুলোর ও বিক্রি বাট্টা কিছুটা হয়তো  বাড়ে। এছাড়া বইয়ের বাজার একেবারেই ক্রেতা শূন্য। শুনে হতাশ হই, দুঃখ পাই। কিন্তু এই অবস্থার একটা পরিবর্তন কি করে আনা যায়! 

এদেশের সুপার মার্কেট কিংবা দোকানগুলোতে কখনো কখনো ফ্রি স্যাম্পল দিয়ে পণ্যর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়। এই যেমন সামারে গার্ডেনিং করার উৎসাহ দিতে সুপারমার্কেট গুলোতে ফ্রি ‘বীজ’ স্যাম্পল হিসেবে দেয়। সে রকম অনেক কিছুরই একটা স্যাম্পল দিয়ে তারপর সেটির প্রতি ক্রেতার আগ্রহ সৃষ্টি করার একটা চেষ্টা করা হয়। সে রকম প্রতিবছর যে টাকায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা হয় সেটা জমিয়ে বই কিনে, প্রদানের একটা প্রবণতা সৃষ্টি করা সম্ভব কিনা ভেবে দেখা যায়। 

তারপর স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত-অপরিচিত, মহলে অন্য উপহারের সাথে একটা করে যদি বই উপহার দেয়া হয় তাহলে হয়তো অনিচ্ছা স্বত্তেও বইটা পড়ার একটা তাগিদ জাগতে পারে। না পড়লেও, নিদেনপক্ষে সুভ্যেনিয়র হিসেবে ঘরে তো অন্ততঃ থাকবে! ফ্রি বই দিয়ে বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আর এটাই বিশ্ব বই প্রদান দিবসের উপজীব্য।

আজকাল মানুষের একটা পরিবর্তন বেশ লক্ষ্য করা যায়। কোন আড্ডা বা মজলিশে বই কিংবা শিল্প সাহিত্ত্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেনা। দর্শন, বিজ্ঞান, লেখালেখি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয় না। আড্ডার বিষয়বস্তুতে প্রধান হয়ে উঠে রাজনীতি, প্রতিপত্তি, বিত্ত-বৈভব আর নিত্য নতুন পোশাক ও জুয়েলারির আলাপে। 

এছাড়াও বাহ্যিক রূপ সৌন্দর্য্য, যশ, প্রাচুর্য আর বিত্তের প্রচার ও প্রকাশে অনেকেই অস্থির! সেই সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় কায়ক্লেশে থাকা জীবনেও এমন সব পোষ্ট বা ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে, যেসব খুব বিভ্রান্তিকর। এইসব বিভ্রান্তিমূলক কাণ্ড কমিয়ে তারা যদি একটু বই পড়ায় মনোযোগী হতো তাহলে সমাজটা বোধহয় আরেকটু সভ্য হতো! 
       
অযোচিত প্রদর্শনীর এই মহামারী নিরাময় করতে পারে বই। অথচ এখন উপহার হিসেবেও মানুষ আর বই আদান-প্রদান করে না। পরস্পর পরস্পরকে বাহারী শাড়ি, জুয়েলারি, ঘর সাজাবার সামগ্রী কিংবা যা কিছুই উপহার দিক না কেন বই অন্ততঃ এই তালিকায় নেই। 
 
শুদ্ধ চিন্তার বিকাশে বই পড়া একটি অতান্ত গুরত্বপূর্ণ অভ্যাস। বিভিন্ন ইলেক্ট্রোনিক্স ডিভাইস থেকে একটু অন্য দিকে নিজেকে ফেরাতে বই বিশেষ ভূমিকা রাখতে সহায়ক। আমরা আবার যদি সে অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনতে পারি সেটা আমাদের শাররিক ও মানসিক দুদিকেই লাভজনক। বই কেনার অভ্যাসে  শোকেসে কিংবা ঘরে রেখে দিলেও কোন এক অবসন্ন সময়ে হয়তো হাতে নিতে ইচ্ছে করবে। অপরের ভাবনাগুলো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। 
  
এখন বই কেনাকে অপচয় মনে করা হয়! অথচ এমন একটা সময় ছিলো যখন জন্মদিন, বিয়ে বা বিশেষ উপলক্ষে আমরা পরস্পরকে বই উপহার দিতে ভালবাসতাম। শুধু ভালবাসাই নয় বলতে গেলে আমাদের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারির নির্বাচন তালিকায় ছিল বই। এখন গিফট তালিকায় সবকিছুই আছে কেবল মাত্র বই ছাড়া। 

এছাড়াও অনলাইনে, ইন্টারনেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে নানারকম পোষ্ট দিই কিংবা পোষ্ট দেখে প্রতিক্রিয়ামুলক অনুভূতি জানাই। এসব প্রতিক্রিয়ামুলক অনুভুতি প্রকাশে সাময়িক তুষ্টি মিললেও দিনশেষে  মানসিক বিষণ্ণতা বাড়ায়। অথচ একটি বই-ই দিতে পারে নির্মল প্রশান্তি। ভালোবাসা প্রকাশের প্রতীক হিসাবে আন্তর্জাতিক বই প্রদান দিবসে পরস্পরকে বই উপহার দিয়ে দিনটিকে আরো অর্থবহ ও উৎসব মুখর করা সম্ভব। 

জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেন হাওয়ার বলেছেন, ‘মানুষ বিভিন্ন প্রকার ইচ্ছাশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সব ইচ্ছার তুষ্টি বিধান করতে পারে না বলেই ব্যাক্তিকে দুঃখময় জীবনযাপন করতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ইচ্ছাকে দমন করা। এবং লোভ-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনার গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা’। 

আমার বিশ্বাস, এটি করতে পারে একমাত্র বই ও বই পড়ার বিগত অভ্যাস ফিরিয়ে আনা। বিশ্ব ‘বই প্রদান’ দিবস থেকেই না হয় শুরু হোক এর মূল্যায়ন!

 

এসআর

×