সাগর রহমান
বিশ্রী আবহাওয়ার ফেরে দিন কাটছে আমাদের। কোনো কোনো দিন মেঘের শত শত্রুতামাখা ঝঞ্ঝা পেরিয়ে যদিওবা সূর্য দেখা দেয় এবং এক-আধাবেলা যদিও বা সোনালি রঙে ঝিলমিলিয়ে ওঠে গাছপালা আর বাড়িঘরের মাথা, তার নিরুত্তাপ আত্মসমর্পণ কেমন যে অসহায় লাগে দেখতে! সুতরাং, আমরা এই-ই আপাতত মেনে নিয়েছি। আমাদের এখানে সূর্যের উত্তরায়ণ চলছে। এ কয়টা দিন আমরা ঘাপটি মেরে পড়ে থাকব। জবুথবু হয়ে হাঁটব, কোট-জ্যাকেট-মাফলার-উলের গলাবন্ধ-কানটুপিতে নিজেদের পোশাকের চলন্ত পাহাড় বানিয়ে এপাশ ওপাশ করব। আমাদের এখন শীতকাল।
অবশ্য উৎসবের সময়ও। রাস্তায় বেরোলেই ক্রিসমাসের সাজ। সান্তাক্লজের উত্তর মেরুর ওয়ার্কশপে ক্রিসমাসের উপহারের প্যাকেট বাঁধাই-ছাদাই চলছে নিশ্চয়ই। হাজার হাজার ক্রিসমাস এলভস আহার-নিদ্রা ভুলে একের পর এক উপহার সামগ্রী প্যাকেট করে যাচ্ছে। ঘরে ঘরে সান্তাক্লজের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করেছে ছোট ছোট বাচ্চারা। তাদের বশে রাখার জন্য বাবা-মায়েরা নিত্য মন্ত্র জপছেন, ‘ভালো হয়ে চলবে যে, ভালো উপহারটি পাবে সে।’
বেশিরভাগ বাচ্চাই অবশ্য এখন সান্তায় বিশ্বাস করে না। তবে এ যুগের সান্তাক্লজ আমাজন ডটকম-এ বিশ্বাস করে। আর উপহার তো উপহারই- তা সে মেরুর দেশ থেকে রেইনডিয়ারের রথে চড়ে, বাড়ির বহুকাল অব্যবহৃত চিমনিটির ফাঁক গলে সাদা দাড়ি-গোঁফের বুড়ো সান্তা আনুক, কিংবা হোন্ডা-ট্রাক-চার চাকার বাহনে চড়ে ইয়াং আমাজনের ডেলেভারিম্যানই সদর দরজার কড়া নাড়–ক। সুতরাং, আগামী কিছুদিন বাচ্চারা একটু-আধটু সমঝে চলবে- আশা করা যায়। অবশ্য উপহারের জন্য চব্বিশ তারিখের মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার কিছু নেই। আমাজনের কর্মী দল দরকারি-অদরকারি পণ্য ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে মরিয়া হয়ে ছুটছে। বেশিরভাগ অর্ডারই এখন ‘দিনের অর্ডার দিনে চাই টাইপ।
একটুও তর সইছে না। মাঝরাতে অর্ডার দিয়েছি। কাল দুপুরের মধ্যে কলিংবেল বেজে ওঠা চাই। জিনিসটা আমার এক্ষুনি দরকার! এক্ষুনি! ফলাফল? আমাজনের গুদামে ১.৬ মিলিয়ন বস্তু প্যাকেটজাত হচ্ছে প্রতিদিন। একটু হিসেব-নিকেশ করলে প্রতি ঘণ্টায় ৬৬ হাজার, প্রতি সেকেন্ডে ১৮.৫টি! সেই যে সুনির্মল বসুর কবিতা আছে না ‘আমাজনের গুদামঘরে, জিনিস যে সব থরে থরে, সার্ফিং করছি কৌতূহলে, কিনছি দিবারাত্র!’ কী বলছেন, এমন কোনো কবিতা নেই, তবে কী আছে -‘এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়, পাঠ্য যে সব পাতায় পাতায়, শিখছি সে সব কৌতূহলে, সন্দেহ নেই মাত্র’? তা হতে পারে, তবে এ যুগে হলে ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে আমার বানানোটাই লিখতেন। নিশ্চয়ই ভুলে যাননি যে আমাজন কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়েছিল মূলত অনলাইনে বই বিক্রির জন্য।
মোদ্দা কথা, শীত বটে, তবে উৎসবের খাজনা এবং বাজনা বাজছে, ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করেছে ঝিকিমিকি আলো। সপ্তাহ দুয়েকের মাথায় বছরকার হলিডে শুরু হয়ে যাবে, সেই আমেজের দিকে চোখ রেখে ক্লান্তিকর দিনাতিপাতও করা যাচ্ছে, তবে ঘরে ফিরে ইউটিউবে বাংলাদেশের সংবাদ দেখতে বসে প্রাণ নির্ভুল আঁইডাই করে উঠছে প্রতিদিন। ওদিকে যে উৎসব শুরু হয়েছে, তার সঙ্গে এই উৎসবের তুলনাই হয় না। নির্বাচনের আমেজে- কোথায় যেন শুনলাম, সংবাদ পাঠিকা বলছেন নির্বাচনের জ্বরে, সারাদেশ যেন থর থর করে কাঁপছে!
যতদূর চোখ যায়, যেখানে যেদিকে চোখ যায়- পোড়া চোখে (চোখের জায়গায় পড়–ন টিভি-ক্যামেরা) কেবলি ‘পতাকা শোভিত স্লোগানমুখর ঝাঁজাল মিছিল।’ এত হাজার হাজার সমাজসেবক চারদিকে- দেখতেও তো চোখ জুড়িয়ে যায়। এই যে সফেদ পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে, নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে, (এবং ঘরের, কিংবা হোটেলের খেয়ে এসে) দেশ ও জাতি এবং সমাজের সেবক হওয়ার আশায় ও নেশায়, সমাজসেবক হওয়ার প্রতিযোগিতায় মরিয়া হয়ে পথে নেমেছেন, প্রার্থনা করছেন সেবা করার সুযোগ পাওয়ার জন্য- এর তুলনা আর কোথায় পাওয়া যাবে। যুক্তরাজ্যে যে পাওয়া যাবে না, তাতে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই!
আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, লন্ডনে আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানকার বর্তমান এমপি কে? তবে আমাকে অনেকক্ষণ ভাবতে হবে। আমার এ অজ্ঞানে আমার নিজের যত না দায় আছে, তাতে উনার, মানে বর্তমান এমপির দায় কোনো অংশে কম আছে বলে আমি মনে করি না। একের পর এক নির্বাচন আসে, যায়- কোথাও একটা জনসভা নেই, মিছিল নেই, মিটিং নেই (নিশ্চয়ই কোথাও আছে, কোথায়- সেটা খোঁজার উৎসাহ হয়নি আমার কখনো), ঘরে ঘরে জনসংযোগ নেই, নিদেন একটা পোস্টার পর্যন্ত নেই রাস্তায়। এখানে ভোটের তোড়জোড় মানে পোস্টে নির্বাচন কমিশন থেকে একটি চিঠি- এ বাড়িতে ভোট দেওয়ার জন্য যারা যারা রেজিস্টার্ড, তাদের নাম-ধাম এবং ঠিকানা ঠিক আছে কি না- সে সব চেক করা, হয়তো নির্বাচনের দিন-তারিখ-ঠিকানা জানিয়ে একটা ই-মেইল/চিঠি, আর নির্বাচনের প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কখনো কখনো ঘরের লেটারবক্স ঠেলে দুয়েকটা লিফলেট আগমন- এর বাইরে আর তেমন কিছু কখনো চোখে পড়েছে বলে তো আমার মনে পড়ছে না।
মনে আছে, প্রথমবার এ দেশে ভোট দিতে গিয়ে বাড়ির পাশের ভোট কেন্দ্রটি খুঁজে পেতে আমার আধা ঘণ্টার মতো লেগেছিল! এ চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে যদি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নির্বাচন দেখি- মনে হতে থাকে হয়তো ভিন কোনো গ্রহের ব্যাপার-স্যাপার দেখছি।
আমাদের ভোট একটা ঘটনা তো বটেই! ওই যে বললাম, এক সঙ্গে এত ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র’ মানুষ দেশের সেবক হওয়ার জন্য হাহাকার এবং মাতমজারি করছেন, কাঁদছেন এবং ককাচ্ছেন, বাদ্য এবং খাদ্য বিলাচ্ছেন, হোন্ডা এবং গুণ্ডাবহরে রাজপথ কাঁপাচ্ছেন- টিভিতে এসব দেখতে দেখতে কত সুখস্বপ্ন যে মনের মধ্যে দোলা দিতে থাকে। সোফার পাশবালিশে কিল (ঘুষিই হবে হয়তো) দিয়ে গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে- আমরা করব জয়, আমরা করব জয়...। বাংলাদেশের শনৈঃ শনৈঃ সামগ্রিক উন্নয়ন আমার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠতে থাকে। আমি টিভি বন্ধ করে, আক্ষরিক অর্থেই উল্লেখ্য ‘জয় করা সংক্রান্ত‘ গানটি গাইতে গাইতে, নিজের লেখার টেবিলে গিয়ে বসলাম।
টেবিলে একটা বই নামানো- ‘ইমরটাল ওয়ার্ডস : হিস্ট্রিস মোস্ট মেমোরিবল কোটেশনস অ্যান্ড দ্য স্টোরিজ বিহাইন্ড দেম।’ হুট-হাট করে এ বইটার দুয়েকটা পাতা উল্টাতে ভালো লাগে আমার। আজকেও কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়া একটা পাতা খুলে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখি- চৈনিক দার্শনিক লাও-তসুর একটি বাণী। লাও-তসুকে আপনারা সবাই চেনেন। যদি নামটি কোনো কারণে ভুলে গিয়েও থাকেন, তবে তার বলা প্রবাদটি শুনেননি, এমন মানুষ পাওয়া অসম্ভব। ওই যে তিনি বলেছিলেন, কাউকে একটা মাছ দিয়ে সাহায্য করলে সে বড়জোর সেদিনটি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। তবে মাছ ধরা শিখিয়ে দিলে সে আজীবন খেয়ে বাঁচতে পারবে। অবশ্য দুষ্টজনে বলে, প্রবাদটি নাকি ঠিক নেই। এর সঠিক রূপটি হবে : কাউকে একটা মাছ দিলে সে বড়জোর সেদিনটি খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।
আর তাকে মাছ ধরা শিখিয়ে দিলে সে সারাবছর পুকুরের মাছগুলোকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে। আচ্ছা, তা যাই হোক, যে পৃষ্ঠায় আমার চোখ, সেখানে দার্শনিকের ওই উক্তিটিই আছে ‘ইমরটাল ওয়ার্ড‘ হিসেবে। আমি সেটা পড়লাম। তারপর প্রবাদের নিচে, যেখানে ছোট হরফে দার্শনিক ভদ্রলোকের সংক্ষিপ্ত জীবনী আছে, সেটা পড়া শুরু করতেই গোল বাধল। ওখানে উনার আরেকটি উক্তি ছাপানো আছে, A leader is best when people barely knwo he exists; when his work is done, his aim fullfiled, they will say : we did it ourselves.
আমি প্রবল দ্বিধায় আছি এখন। টিভির খবরে দেখা ওই হাজার হাজার গলা উঁচানো হাত উঠানো হাসি ছড়ানো ‘আমাকে দেখ, আমিই শ্রেষ্ঠ, জনগণ আমাকে চায়’ বুলি কপচানো নেতাকে বিশ্বাস করব, না আড়াই হাজার বছর আগে মরে যাওয়া এক চৈনিক বৃদ্ধকে!
৮ ডিসেম্বর ২০২৩