ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ রোলমডেল

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৭ ডিসেম্বর ২০২৩

জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ রোলমডেল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যতম

জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে নিজের কোনো দোষ ছাড়াই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। দেশটি প্রায়ই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তাপপ্রবাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশটির অনেক অংশ ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। প্রকৃতির এসব বিরুদ্ধতার মুখে এ দেশের মানুষের টিকে থাকা ও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি-সহিষ্ণুতার খবরও ঢের রয়েছে। যদিও বহির্বিশ্বের মানুষ এসব আগে জানেনি। বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃতির এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে শুধু যে টিকে থাকতেই জানে না, বরং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো দক্ষভাবে মোকাবিলা করার সুদূরপ্রসারী কর্মকৌশলও নিতে পারেÑ এটি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কল্যাণে বিশ্ববাসী জেনেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ সম্মাননায় ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি পুরো দেশকে সম্মানিত করেন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যতম যোদ্ধা হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। বর্তমানে যত সরকার প্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছেন তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার রয়েছেন। তারই পরিচায়ক এশিয়া ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তি। এ পুরস্কার জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের পক্ষে তার সোচ্চার নেতৃত্বের স্বীকৃতি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য এর আগেও তিনি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পেয়েছেন।

পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় প্রধানমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। তিনি সফলভাবে নেতৃত্ব দেন জলবায়ুর দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সংগঠন ক্লাইমেট ভালনেরাবিলিটি ফোরামের। জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তার সক্রিয় উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি তার প্রতিটি বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ এবং অভিযোজন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নানা পদক্ষেপ ও কর্মসূচি তুলে ধরেছেন। বিশেষত প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের অভিযোজন, প্রশমন, জলবায়ু অর্থায়ন, লস-অ্যান্ড-ড্যামেজ, প্রযুক্তি আহরণ ও হস্তান্তরসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা তিনি সর্বদাই চলমান রেখেছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় শেখ হাসিনাকে বলছে ‘দুর্গতদের কণ্ঠস্বর’। ঠিক যেমন করে তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হতো সারাবিশ্বের ‘শোষিতের কণ্ঠস্বর’। 
শুধু বক্তব্যে নয়, লেখনীর মাধ্যমেও প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে সোচ্চার। বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইকে জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। শেখ হাসিনার মতে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন হলো একটি বৈশ্বিক বিপর্যয় যা গরিবদের ওপর ধনীরা চাপিয়ে দেয় এবং ক্রমবর্ধমান হারে এটি তাদের নিজেদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লড়াইয়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের দায়িত্ব দিতে হবে এবং এই লড়াইয়ে তাদের অর্থায়ন করতে হবে’। এমন বলিষ্ঠ ও সাহসী মতবাদ বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের পক্ষে সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে।

দেশকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে তার অঙ্গিকার, বিশ্বের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশের পক্ষ হয়ে সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান, সব মিলিয়ে তিনি আবারো কপ-২৮ সম্মেলন থেকে  এশিয়া ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হলেন। তার এই পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলাদেশকে আরও একবার সম্মানিত করেছে বিশ্বে। 
প্রধানমন্ত্রী তার উদ্ভাবনী পদক্ষেপের মাধ্যমে দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি আদর্শ মডেল ও অনুস্মরণীয় দেশে পরিণত করার পথে এগিয়ে চলেছেন। শেখ হাসিনার দশটি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি গ্রাউন্ড-জিরো দেশ হিসেবে নিজের কোনো দোষ ছাড়াই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। দেশটি প্রায়ই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, তাপপ্রবাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশটির অনেক অংশ ডুবে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। প্রকৃতির এসব বিরুদ্ধতার মুখে এ দেশের মানুষের টিকে থাকা ও ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি-সহিষ্ণুতার খবরও ঢের রয়েছে।

যদিও বহির্বিশ্বের মানুষ এসব আগে জানেনি। বাংলাদেশের জনগণ প্রকৃতির এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে শুধু যে টিকে থাকতেই জানে না, বরং বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিগুলো দক্ষভাবে মোকাবিলা করার সুদূরপ্রসারী কর্মকৌশলও নিতে পারেÑ এটি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কল্যাণে বিশ্ববাসী জেনেছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মান ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ সম্মাননায় ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি পুরো দেশকে সম্মানিত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সম্মাননা জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বিশ্ব ফোরামে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের মুখপাত্র হিসেবে নেতৃত্ব দেওয়ার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার দেশে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জলবায়ুর দুর্বলতাসমূহকে জলবায়ু সমৃদ্ধিতে রূপান্তর করতে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নিজস্ব অর্থায়নে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ক্লাইমেট ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। শুধু তাই নয়, ২০১৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এই খাতে ব্যয় করবে আরও চার হাজার কোটি ডলার।

এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ প্রণয়ন করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় আজ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে রোল মডেল। বিজ্ঞান ভিত্তিক আবহাওয়া ও জলবায়ুর উন্নততর পূর্বাভাস প্রদানের মাধ্যমে ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নে ‘বাংলাদেশ আঞ্চলিক আবহাওয়া ও জলবায়ু সেবা প্রকল্প (কম্পোনেন্ট-এ)’ চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আবহাওয়া পরিষেবার মান বৃদ্ধি পাবে বহুলাংশে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় অবদান রাখার পাশাপাশি বিশ্বজনীন আলোচনায় স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সদা সচেষ্ট রয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যে জলবায়ুর দিক দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রকৃত নেতা তা তার বলিষ্ঠ উচ্চারণের মাধ্যমে বার বার প্রমাণ করেছেন। তার অন্যতম একটি বক্তব্য হলো- ‘আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে।

তখন সেখানকার মানুষ কোথায় যাবে, সে কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনন্য দক্ষতা ও সাফল্য প্রদর্শনের সুবাদে সমগ্র বিশ্বের কাছে বর্তমানে একটি রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের জন্য বাংলাদেশকে একটি মডেল হিসেবে বর্ণনা করে জানিয়েছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনে বাংলাদেশ সেরা শিক্ষক।’ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করে তিনি জানিয়েছেন, ‘শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি নিয়ে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
এই পৃথিবীতে যাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে না আসে, সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মধ্যে থাকা সব স্বল্পোন্নত দেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রায়ই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে তার জলবায়ু এজেন্ডা বিশ্বনেতাদের সামনে উপস্থাপন করে প্রশংসিত হচ্ছেন। তিনি উদ্ভাবনমূলক নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যেমন বাংলাদেশকে প্রস্তুত করে তুলছেন, তেমনই বিশ্ব বিবেককে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর উদ্ভাবনী ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কক্সবাজারে বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ৪০০ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য কক্সবাজারে বিশ্বের বৃহত্তম বহুতল সামাজিক আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। ইউএনজিএ৭৮ ক্লাইমেট মোবিলিটি সামিট চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভিবাসন এবং বাস্তুচ্যুতির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ক্লাইমেট মোবিলিটি লিডার পুরস্কারটি মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তিনি সমগ্র বিশ্বের দুর্গতদের কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন ‘জলবায়ু যোদ্ধা’ হিসেবে। তার এই সুদৃঢ় মনোভাব বাংলাদেশকে সব সংকট মোকাবিলা করে উন্নত, আধুনিক ও টেকসই দেশে পরিণত হওয়ার পথে অব্যবহিতভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।

লেখক : অধ্যাপক, ট্রেজারার
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×