ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

বিজয়ের মাসের প্রত্যাশা

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ২ ডিসেম্বর ২০২৩

বিজয়ের মাসের প্রত্যাশা

বিজয়ের মাস বাঙালির কাছে গৌরবের, আনন্দের ও আবেগের

বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি নিবেদন থাকবে, এ মাসের জন্য হলেও সকল ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে। কেননা, বিজয়ের মাস প্রতিটি বাঙালির নিকট অত্যন্ত আবেগের। এ জায়গায় আঘাত করা হলে সবটাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। হরতাল-অবরোধ রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল হিসেবে আহ্বান করলে দলের জনসমর্থন ক্রমান্বয়ে কমে আসবে

বিজয়ের মাস বাঙালির কাছে গৌরবের, আনন্দের ও আবেগের। বিজয়ের বার্তা সকল পেশা শ্রেণির মানুষের নিকট সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেশপ্রেমিক সকলের। ডিসেম্বর মাস এলেই বাঙালির মনে এক ধরনের বিশেষ ভাবাবেগের আবির্ভাব ঘটে। যেই আবেগের প্রেরণা ও দ্রোহে সারাবছর বাঙালিরা তাদের নিজেদের দায়িত্ব, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের কর্তব্য প্রভূত বিষয়াবলি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জ্ঞাত হয়। বিজয়ের মাসকে ঘিরে রাজনীতিবিদদের বিশেষ পরিকল্পনা থাকে। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতেও বিজয়ের মাসকে নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের কল্যাণে দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাজনীতিবিদদের আহ্বানে এ দেশের আপামর জনসাধারণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশমাতাকে মুক্ত করেছে।

সুতরাং রাজনীতিবিদগণ নিজেদের ভূমিকার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়েও জনসাধারণের মুখোমুখি বসার একটি বিশেষ মাস ডিসেম্বর। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাঙালি জাতি বিনম্র চিত্তে অবনত মস্তকে স্বাধীনতার ত্যাগী মানুষদের অবিস্মরণীয় ভূমিকাকে গভীরভাবে স্মরণ করে। 
তবে এবারের বিজয়ের মাসের আলাদা একটি বিশেষত্ব রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের নিমিত্তে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। মনোনয়ন দাখিলও সম্পন্ন। আবার নির্বাচনকে বানচাল করতে একটি গোষ্ঠী হরতাল-অবরোধ ডেকে বিজয়ের মাসকে সঠিকভাবে উদ্যাপনের সুযোগ দিচ্ছে না দেশবাসীকে। যদিও দেশের আপামর জনসাধারণ হরতাল-অবরোধকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তথাপি মানুষের মধ্যে একটি ভয় ও শঙ্কা কাজ করে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের আগুন সন্ত্রাসে যারা হতাহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা থাকে, যে কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হওয়ার। সে ভাবনা থেকেই অনেকেই ঘর থেকে বের হতে ভয়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকে দুশ্চিন্তায়।

আগুন সন্ত্রাসীদের ভয়ে মানুষ দিবস উদ্যাপনের বিষয়ে কিছুটা হলেও ভয়ে তটস্থ। এই যে বিজয়ের মাসের তাৎপর্যকে ভূলুন্ঠিত করা হচ্ছে, এর দায় কিন্তু হরতাল-অবরোধ আহ্বানকারীদের নিতেই হবে। কারণ, হরতাল-অবরোধ সাধারণ জনগণ প্রত্যাখ্যান করলেও বাসে-ট্রেনে আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ধ্বংস করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মন ও মননের স্বাভাবিকতা নষ্ট হবে, এটাই চিরায়ত নিয়ম। বাস্তবে এ মাসে সকল রাজনৈতিক দলের বিজয়ের মাসকে উদ্যাপনের জন্য আলাদা কর্মসূচি থাকার কথা। অবশ্য যারা দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে দালালি করেছে, তাদের বিষয় আলাদা। তারা কখনোই বিজয়ের মাসের কর্মসূচিকে বিজয়ের মর্মার্থ দিয়ে উদ্যাপন করবে না। উল্টো বিজয়ের আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করতে উঠে পড়ে লাগবে। লেগেছেও।
বিজয়ের মাসের কর্মসূচিকে বিভিন্ন উপায়ে উদ্যাপন করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেশপ্রেমের মাহাত্ম্যকে তুলে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার ওপর নির্মিত নাটক-সিনেমা টিভি চ্যানেলগুলোতে পরিবেশিত হতে পারে। চলচ্চিত্র অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর যৌথভাবে গ্রামেগঞ্জে এমনকি শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র পরিবেশন করতে পারে। প্রিন্ট মিডিয়াগুলো আরও বড় পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে বিস্তারিতভাবে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারে।

প্রথিতযশা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে দেশব্যাপী যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত আলোচনা অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীর আয়োজন করতে হবে। অনেকের মধ্যে দেখা যায়, দেশকে নিয়ে জানার আগ্রহ কম। এছাড়াও দেখা যায় বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা-ভক্তি ও যথাযথ মর্যাদায় পর্যবসিত করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কারিকুলাম প্রণয়নের কাজ হাতে নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ কোর্স প্রণয়নের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাস্তবায়ন চোখে পড়ছে না।

আবার যে সকল জায়গায় পড়ানো হয়, সে সকল প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় নানামুখী কারণে এ কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তুলনামূলক কম। এ বিষয়েও তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। এ সকল কিছুর ব্যত্যয় হলে দেখা যাবে আমাদের শিক্ষার্থী তথা নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিজয়ের মাসের তাৎপর্য সঠিকভাবে নিরূপিত হবে না। 
বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের প্রতি নিবেদন থাকবে, এ মাসের জন্য হলেও সকল ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেবে। কেননা, বিজয়ের মাস প্রতিটি বাঙালির নিকট অত্যন্ত আবেগের। এ জায়গায় আঘাত করা হলে সবটাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। হরতাল-অবরোধ রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল হিসেবে আহ্বান করলে দলের জনসমর্থন ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। তাছাড়া একটি সময়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে হরতাল-অবরোধ থাকলেও কালের পরিক্রমায় বর্তমানে হরতাল-অবরোধের গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে।

সে কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়নে আরও সতর্ক ও সচেতন হওয়া। দেশব্যাপী প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ব্যানারে বিজয়ের মাসের কর্মসূচি উদ্যাপিত হলে বিজয়ের মাসের উপজীব্যকে নিয়ে আলোচনা হওয়ায় নতুন প্রজন্মের সারথিরা বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে জানার সুযোগ পাবে এবং উজ্জীবিত হবে দেশপ্রেমে। 
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করেন, তাদের সমন্বয়ে জাতীয়ভাবে সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজন করা যেতে পারে। এ কাজগুলো নিয়মিতভাবে হলে পূর্বপুরুষদের প্রতি আমাদের সম্মানের জায়গা আরও প্রস্ফুটিত হবে। বিজয়ের মাসের গৌরবোজ্জ্বল মাহাত্মকে আরও বেগবান করার প্রয়াস পাবে। স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট থেকে গল্প শোনার তাগিদে হলেও অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে। পাশাপাশি যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, সরাসরি রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিল, দেশী-বিদেশী চক্রান্তে মদত প্রদান করেছিল, তাদের বিষয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। এরা দেশ ও জাতির শত্রু।

যারা এখনো তৎপর এবং তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রও জড়িত। এরা সুযোগ পেলেই দেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালায়। প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে দেয়। দেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভর করে থাকে, সেখানে জনগণ তাদের নিকট গুরুত্বহীন। এদের চরিত্র সম্পর্কেও দেশের মানুষকে জানাতে হবে। প্রয়োজনে মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে জনগণের সামনে। অবশ্য বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত সচেতন। নির্বাচনে তথা ভোটের মাঠে তাদেরকে বরাবরই এ দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। বিজয়ের মাসের আলোচনায় এ বিষয়গুলো আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসতে পারে। 
সর্বোপরি বলা যায়, এ প্রজন্মের জন্য দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ ইত্যাদি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা তুলে ধরার জন্য হলেও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বিজয়ের মাসের গুরুত্ব ও মর্মার্থকে বিশ্লেষণ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংলাপ, সেমিনার ও আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা উচিত। এ সব আলোচনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস বের হয়ে আসতে পারে। যে সকল বিষয় আমাদের জাতির নিকট অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। কাজেই মহান বিজয়ের মাসের মর্মার্থ বিবেচনায় এ দেশের সকল নাগরিকের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্যে বিনম্র চিত্তে ব্যাপক উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা আবশ্যক।
     
লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×