
মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী
মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে দেশপ্রেমের অমিয় শক্তিতে। সেটাই তাদের ভয়ের কারণ। চলচ্চিত্রটি নগর থেকে গঞ্জে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষের মধ্যে একটি জাগরণ সৃষ্টি করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করেছে। তাতে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের উত্তর পুরুষদের হৃদকম্পন শুরু হয়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পাঁচশ শিক্ষক একসঙ্গে দেখে এলাম বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক সিনেমা ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার।’ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি মির্মিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এটি পূর্ণাঙ্গ সিনেমা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে সিনেমাটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ছবিটি যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু সমালোচনাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিহাস গবেষক হিসেবে এবং একজন দর্শক হিসেবে সিনেমাটি মূল্যায়ন করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা এ নিবন্ধের লক্ষ্য।
প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর প্রায় ৫৫ বছরের কর্মমুখর জীবনের ইতিহাস মাত্র তিন ঘণ্টার সেলুলয়েডে অন্তর্ভুক্ত করতে সিনেমাটির কাহিনী লেখক বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। মনে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই তিনকালের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ রকম একটি ঘটনাবহুলের সময়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তাঁকে এত কম সময়ে পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরার অসাধ্য সাধনের কাজটিই এখানে করতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে উপমহাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ছবিটি পরিচালনা করতে গিয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন, তা আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শূটিং চলাকালে প্রত্যক্ষ করেছি। লোকেশন হিসেবে স্বাধীনতা সূতিকাগার বঙ্গবন্ধুর মাতৃসম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থানও ছবিতে দৃশ্যায়িত হয়েছে।
মূল কাজটি মুম্বাইয়ের বিখ্যাত সেট ও স্টুডিওতে হয়েছে। ছবির শুরুতে আবহমান গ্রাম-বাংলার চিরায়ত দৃশ্য এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে, যাতে বিশ্বকবির গান এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির কবিতায় চিত্রিত সোনার বাংলাকে এক ঝলকে দেখে নেওয়া যায়। বাংলাদেশ তো অনেক বদলে গেছে। সেখানে ১৯৩০-এর দশকের বাংলায় ফিরে যাওয়ার মতো কঠিন কাজটি করতে সে রকম জরাজীর্ণ গ্রামীণ জীবনের দৃশ্যায়ন বস্তুত অর্থে ছিল চ্যালেঞ্জিং। শেখ হাসিনা তাঁর বাবার রেখে যাওয়া স্বাধীন দেশটিকে উন্নয়নের নানা অলংকারে বদলে দিয়েছেন। ছবির কলাকুশলীরা সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা কোনো শিল্পীর পক্ষে সম্ভব নয়। সেই অসম্ভব কাজটি সুন্দরভাবে করেছেন আরেফিন শুভ।
বঙ্গবন্ধুর পিতার চরিত্রে বর্তমানকালের দর্শকনন্দিত অভিনয় শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী, খুনি মোশতাকের চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, ফজিলাতুন নেছা চরিত্রে তিশা, শেখ হাসিনা চরিত্রে নুসরাত ফারিয়া এবং ছোটবেলার বঙ্গবন্ধু চরিত্রে সৌম্যসহ সকলেই অনবদ্য অভিনয় করেছেন। আবহ সংগীত ও দৃশ্যায়ন বাস্তবতার কাছাকাছি। বঙ্গবন্ধু শেখ ফজিলাতুন নেছার বিয়ের গানটি বাংলাদেশের লোক-সংস্কৃতিকে উপস্থিতিত করে। বঙ্গবন্ধু-ফজিলাতুন নেছার বিয়ের বয়স নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেছেন। আসলে ছোটবেলায় তাঁদের বিয়ে হলেও ফুলসজ্জার সময় একটি আনুষ্ঠানিকতা ছিল, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে তার ইঙ্গিত মেলে। এটি তারই একটি প্রতীকী রূপায়ণ।
দ্বিতীয়ত, ছবিটি ঐতিহাসিকতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। সাধারণত ইতিহাসনির্ভর ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে ছবির প্রয়োজনে কিছু কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করা হয়। ছবির দর্শকপ্রিয়তার প্রয়োজনে সংযোজন করা হয় খানিকটা রূপ-রস। কিন্তু মুজিব: একটি জাতির রূপকার সিনেমাটিতে কোনো ধরনের অতিরঞ্জন নেই। বরং সময়ের অভাবে অনেক কিছু আনতে পারা যায়নি। কিন্তু ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রচেষ্টা রয়েছে। প্রচেষ্টা রয়েছে সঠিক মাপকাঠিতে ইতিহাসকে তুলে আনার। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন যশোর রোডের দৃশ্য, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকারসহ তৎকালীন সময়ের কিছু রিয়েল ফুটেজ এ ছবিতে ব্যবহারের মাধ্যমে দর্শকদের সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
বিশেষ করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সাক্ষাৎকারের একটি জায়গায় বলছেন, গণহত্যা দেখে চুপ করে বসে থাকাটাও গণহত্যায় সহযোগিতার শামিলÑ এই কথাটি বর্তমানকালেও প্রযোজ্য। সিনেমায় টুঙ্গিপাড়ার খোকা কলকাতার শিক্ষাজীবনের পাঠ শেষ করার সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনেরও অবসান হয়। তিনি ঢাকায় ফিরে নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সফল হলেও তাঁর নিজের তৈরি স্বাধীন দেশে সপরিবারে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। ছবির এ অংশে বেদনায় ভরা দৃশ্যগুলো দর্শকদের হৃদয়ে অসহনীয় অনূভূতির জন্ম দিয়েছে।
আমাদের সঙ্গে যে সকল শিশু-কিশোর ছিল, তারা দৃশ্যগুলো সহ্য করতে পারছিলেন না। ছোট্ট শেখ রাসেলের নির্মম হত্যা তাদের শিশু হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আশপাশের অনেককে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি। আমার পাশে বসা চঞ্চল চৌধুরী একজন অভিনেতা হয়েও বারবার চোখ মুছছিলেন। আসলে আমরা কেউই সে সময় ঠিক থাকতে পারছিলাম না। ধারণা করা যায়, ছবির চেয়ে বাস্তবতা ছিল আরও নির্মম-নির্দয়। পুরো হল এক নিদারুণ কষ্টের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল।
ছোটবেলায় হলে ছবি দেখে কষ্টের দৃশ্যে গুমরে কেঁদেছি। মুজিব সিনেমাতেও চোখের জল সামলানো যায়নি সে সময়ের নির্মমতার কথা ভেবে। সামান্য মনুষ্যত্ব যার মধ্যে আছে, সে এ সিনেমাটি দেখে আবেগে বিহ্বল হতে বাধ্য। তবে আমার মতে, এখানে খল নায়কদের কনভারসেশনগুলো আরও দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন ছিল। সেক্ষেত্রে অন্য বই থেকে তথ্য নেওয়ার প্রয়োজন হতো না। লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিমের স্মৃতিকথা যা দেখেছি যা বুুঝেছি যা করেছি বইটিই যথেষ্ট। মেজর ডালিম তো খুনি চক্রের একজন। কাজেই তার লেখা ইতিহাস তারা নিশ্চয় অস্বীকার করবেন নাÑ যারা মুজিব হত্যায় খুশি হয়েছিলেন। মুজিব হত্যায় বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন।
এই ছবিটি সকলের দেখা উচিত। বিশেষ করে যারা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুর সময়কে দেখেননি, তাদের জন্য সিনেমাটি দেখা আবশ্যক। বাংলাদেশ কিভাবে স্বাধীন হলো তা জানার জন্য বই তো কেউ প্রায় পড়েই না। তিন ঘণ্টার এই সিনেমাটি দেখলে তারা মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের একটি সম্যক চিত্র পেয়ে যাবে। তাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। যা তাকে সঠিক ইতিহাস জানতে অনুপ্রাণিত করবে। যেমন- আমার নবম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে সিনেমাটি দেখে এসে বলছে- ‘আমার খুব খারাপ লেগেছে। আচ্ছা বাবা, কারা মুজিবকে হত্যা করল, কেন করল- এ রকম কত প্রশ্ন সে আমাকে করে যাচ্ছে। শিশু মনে এই যে জিজ্ঞাসার জন্ম নিল, সেই প্রশ্নই তাকে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানতে আগ্রহী করবে। কেননা, কারও মনে একটি প্রশ্নের জন্ম হলে সে তার উত্তর খুঁজবেই, এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
সে কারণে সিনেমাটি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিশুদের দেখানো উচিত। সিনেমাটি বাংলাদেশবিরোধী শক্তির ভয়ের একটি কারণও বটে। যারা সিনেমাটির সমালোচনা করছে বা লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছে, তারা আসলে ভয় পাচ্ছে। কেননা, তারা ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে কয়েকটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই প্রজন্মের আমিও একজন। আমাদের সময় কী ইতিহাস পড়ানো হতো! আর এখন একজন ইতিহাস গবেষক হিসেবে দেখতে পাচ্ছি ইতিহাসের বাস্তবতা কোন্টি।
যারা একজন মেজরকে সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি বলে লিগ্যাল নোটিশ দিচ্ছে, তারা এক অর্থে ঠিকই বলেছে। সিনেমায় মেজর সাহেবের কোনো বক্তব্য বা ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। মুজিব হত্যায় সেই মেজর সাহেবের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা লে.কর্নেল ডালিমের
বইতে উঠে এসেছে। কাজেই সেই মেজর সাহেবের বঙ্গবন্ধুবিরোধী ভূমিকা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি। ডালিমের বইতে উঠে আসা কর্মতৎপরতার খানিকটাও যদি এখানে সংযোজিত হতো, তাহলে অনেকের মুখ বন্ধ হয়ে যেত। কাজেই সিনেমাটির কোনো দুর্বলতা যদি থেকে থাকে, তা হয়েছে এখানে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা আজ যে ভাষায় কথা বলছে, তা অশনি সংকেত। পাকিস্তানিদের দোসর এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের সহয়তাকারীদের উত্তর প্রজন্ম এখনো মানুষ হয়নি। তারা এখনো রাজাকারই রয়ে গেছে। ‘শেখ হাসিনার বাপের নাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম’- এই বাংলায় এ ধরনের স্লেøাগান দেওয়ার সাহস পায় কারা? কে এই দেশ স্বাধীন করেছিল সেই যাদের নেই, সে কিভাবে এ দেশের নাগরিকত্ব দাবি করে। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম কী এদের জন্যই লিখে গিয়েছিল- ‘সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’? আওয়ামী লীগের সব কাজ পছন্দ হবে সেটা দাবি করার কোনো কারণ নেই। শেখ হাসিনাকে সবাই পছন্দ করবেন সেটাও আশা করা যায় না।
কিন্তু জাতির পিতার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন সেটি একটি অসভ্যতা আর বর্বরতার পরিচায়ক। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন অসভ্যতা দেখা যায় না। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়কালে যারা মুক্তি সংগ্রামের বিপরীতে ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, তারা বঙ্গবন্ধুকে ভয় পেয়েছে। স্বাধীন জাতিসত্তার অগ্রযাত্রাকে থামাতে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তারা সাময়িকভাবে সফল হলেও বঙ্গবন্ধু আবারও স্বমহিমায় জাতির সামনে ফিরে এসেছেন। জাতীয় পাঠ্যসূচিতে, সিনেমা-চলচ্চিত্র, কবিতা ও গানে, সংগ্রামের মিছিলে মুজিব জাতির সঠিক পথের দিশা হয়ে ফিরে এসেছে।
মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে দেশপ্রেমের অমিয় শক্তিতে। সেটাই তাদের ভয়ের কারণ। চলচ্চিত্রটি নগর থেকে গঞ্জে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মানুষের মধ্যে একটি জাগরণ সৃষ্টি করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করেছে। তাতে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের উত্তর পুরুষদের হৃদকম্পন শুরু হয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের গালগল্প মহাসমুদ্রের রণ ধ্বনিতে। জয়বাংলার গগনবিদারী স্লোগান তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। তাই তারা অপপ্রচার শুরু করেছে মুজিব সিনেমাটির বিরুদ্ধে।
তাদের অপপ্রচারের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, মুজিব যুগে যুগে মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার প্রতীক হিসেবে জাজ্বল্যমান। সিনেমার মুজিবও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। শেখ মুজিব : একটি জাতির রূপকার সিনেমাটিই হোক আগামী প্রজন্মের মুজিব পাঠ ও বাংলাদেশ শিক্ষার পাঠশালা। এবারের মুক্তিযুদ্ধে এই সিনেমাটিই লড়বে যাবতীয় অপশক্তির বিরুদ্ধে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ও প্রাধ্যক্ষ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়