
ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
মানুষ জন্ম নেওয়ার পর থেকে ক্রমেই বেড়ে ওঠে। সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখের নানা পথ পাড়ি দিয়ে কিশোর ও যৌবন পাড়ি দিয়ে পৌঁছে জীবনের ক্রান্তিলগ্নে। একসময় শরীরে বার্ধক্য আসে। কমে আসে কর্মক্ষমতা। সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিটি মানুষের জীবনেই এই চক্র আবর্তিত। আজ আমাদের মা-বাবা প্রবীণ ব্যক্তি। আগামীকাল আমার জন্যও এই সময়টা অপেক্ষা করছে। বার্ধক্য প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষের জীবনে বার্ধক্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই স্বাভাবিক নিয়ম কখনো কখনো মানুষের জীবনে বয়ে আনে অনেক দুঃখ, কষ্ট। সময় ও শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি প্রবীণদের মানসিক পরিবর্তন স্বাভাবিক।
এ সময় তাদের একাকিত্ব বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে তাদের আশপাশের মানুষের উচিত পাশে থাকা। সাহায্যের হাত বাড়ানো। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ প্রবীণ ব্যক্তিই অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার। জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানব জীবনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করে আসছে। প্রতিবছর জাতিসংঘ থেকে প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এ বছর প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- Fulfilling the promises of the universal declaration of human rights for older persons: across generations’ ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা।’
স্বাভাবিকভাবে ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে আমাদের দেশে প্রবীণ বলা হয়। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর। তবে বিচারপতিদের জন্য ৬৭ বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্য কোনো পেশাজীবীর জন্য ৬৫ বছর। কারণ, এ বয়সের পর মানুষের দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের কাজ থেকে অবসর নেয়। বিশ্বে উন্নত দেশগুলোতেও ৬০ বা ৬৫ বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ প্রবীণ হবে। ২০৪৪ সালে যা কমবয়সী জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছেন প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ প্রবীণ। ২০২৫ সালে এর সংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ, ২০৫০ সালে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৬১ সাল নাগাদ হবে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা-প্রযুক্তি, জীবন-সচেতনতা এবং যাতায়াত-যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ুস্কাল অনেক বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবীণ সেবার পরিধি অত্যন্ত সীমিত। বেসরকারি প্রবীণ নিবাসগুলোর অধিকাংশের অবস্থা শোচনীয়। বৈশ্বিক মহামারি দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রবীণদের জন্য প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির সময় তাদের যথাযথ সুরক্ষা এবং সহায়তা প্রদান করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।
বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ নিজেদের সন্তান-সন্তুতি কর্তৃক প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও পাঠানো যাবে না মর্মে আইনের বিধানটিও লঙ্ঘিত হচ্ছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য এখনো অনেক প্রবীণকে কোনো না কোনো ধরনের কায়িক প্ররিশ্রম করতে হয়। অনেক প্রবীণকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিদ্রায় যেতে হয়। তাঁদের প্রায় অর্ধেকেরই কোনো না কোনো রকমের পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন।
পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকারী দেশের প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠরা। কারণ, অতীতে তারাই দিবানিশি শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে আমাদের গড়ে তুলেছেন। লেখাপড়া শিখিয়ে নির্বোধ থেকে বোধস¤পন্ন মানুষে পরিণত করেছেন সন্তানকে। আজকের যুবককে কর্মক্ষম ও সচল করে তোলার জন্য প্রবীণ বা বৃদ্ধ মা-বাবার অবদানই সব। কিন্তু প্রবীণ ব্যক্তিরা এখন দেশে বিভিন্ন স্থানে অনিরাপদ এবং নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা নিজ পরিবারেই তাদের সম্মান ও ক্ষমতা হারাচ্ছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে অসচ্ছল ও রোগাক্রান্ত প্রবীণরা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং ভৌত-অবকাঠামোর প্রবীণবান্ধবকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক সম্মানবোধ ও মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে করুণা নয়, বরং শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সকল সন্তান তথা দায়িত্বপ্রাপ্তদের প্রবীণদের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে। অধিকারের প্রশ্নে নয়, বরং তাদের জীবনেরও শেষ ভাগ যেন সফল, সার্থক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আপনজনের সান্নিধ্যে কাটে, তা নিশ্চিত করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব হতে হবে। কারও জীবনের শেষ সময়টা যেন পরিবারহীন বৃদ্ধাশ্রমে না কাটে। বৃদ্ধাশ্রম যেন কোনো বাবা মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা না হয়, এই হোক সকলের অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়