
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া আধুনিক বাংলাদেশের অনন্য স্থপতি। নতুন বাংলাদেশকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নিরন্তর লড়াই- সংগ্রামে অবিচল এক নেতৃত্ব। শুধু তাই নয়, সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নারীদের প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধতায় তাদের এগিয়ে নেওয়ার মহাপ্রকল্পে স্থির ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ঘোর অন্ধকারে উদ্দীপ্ত আলোর প্রজ্বলিত শিখায় আগামীর বাংলাদেশকে যে মাত্রায় পূর্ণ করে চলেছেন, সেখানে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বর্তমানে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে দরাজকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন বিশ্বশান্তি ও প্রগতির যথার্থ রূপরেখা। নারীর সমঅধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বে নারী নেতৃত্বের এগিয়ে আসা যে সময়ের আহ্বান, তাও দ্বিধাহীনভাবে তুলে ধরলেন।
জাতিসংঘের মূল অধিবেশনের প্রাক্কালেই জানালেন নারীর প্রতি তাঁর সহমর্মিতা, দায়বদ্ধতা এবং তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে নির্বিঘ্ন ও নিরন্তর করার সমূহ সম্ভাবনা। নিউইয়র্কে বিশ্ব নারী নেতৃত্বের বার্ষিক সভায় যোগ দেওয়া তাঁর ঐতিহাসিক ও প্রাসঙ্গিক কর্মযোগের দুরন্ত অভিগমন তো বটেই। নারী যখন লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়, সমঅধিকার থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে থাকে সেটা কোনো আধুনিক ও প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সমাজের জন্য মঙ্গল বার্তা বয়ে আনে না।
মানুষের মৌলিক আর ন্যায্য অধিকার থেকে বারবার পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে নতুন আলোর পথ দেখাতে প্রধানমন্ত্রীর অনন্য অবদান সত্যিই নজরকাড়া। এবারের উইমেন লিডারদের বার্ষিক সভায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় বললেন, জাতিসংঘকেই নজির তৈরি করতে হবে নারীদের সার্বিক অধিকার ও উন্নয়নের। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে নারীর যথার্থ স্বাধীনতা নিয়ে বহুবার আলোকপাত করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় এই বিষয়ের ওপরই বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর প্রয়োজনীয় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে অবশ্যই নারীকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শুধু তাই নয়, আপন যোগ্যতা আর কর্মক্ষমতায় নেতৃত্বের শীর্ষপদে উঠে আসাও এক অবধারিত যাত্রাপথ, যে অনন্য শুভ যাত্রায় নারীরা মান্ধাতা আমলের সব অপসংস্কার থেকে বের হয়ে আসবে। নিজের অধিকার ও স্বাধীনতার যুগোপযোগী প্রয়োগে চলার পথকে নিষ্কণ্টক করাও আধুনিক যুগ ও কালের সুনির্দিষ্ট গন্তব্য। জাতিসংঘের মতো অনন্য বিশ্বসংস্থা সেই যাত্রাপথের অংশীদার হিসেবে নারী নেতৃত্বকে স্বাগত জানাবে।
নিজ উদ্যোগে নেতৃত্ব তৈরিতেও আধুনিক বিশ্বে নজির সৃষ্টি করে সমসংখ্যক এই অংশকে তাদের ন্যায্যতায় অধিষ্ঠিত করবে। প্রধানমন্ত্রী ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আক্ষেপ জানান জাতিসংঘের মূল নেতৃত্বে নারীদের অনুপস্থিতির কথা। বিশেষ করে কোনো নারী আজ অবধি এই বিশ্বসংস্থার মহাসচিবের পদটি অলঙ্কৃত করতে পারেননি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের যাত্রা শুরুর আগেই প্রধানমন্ত্রী নারী-বিষয়ক বিভিন্ন আধুনিক কর্মযোগকে সামনে এনে তাদের এগিয়ে চলার পথযাত্রাকে নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্য করার ওপরও বিশেষ আহ্বান জানান। তবে বিশেষ সংস্থা নয়, বরং নারীদের নিজেদেরকেই সাবলীলভাবে এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অধিকার ও পদসমূহে। নিজেদের বৈশ্বিক অবস্থান তৈরিতে সংশ্লিষ্টদের যথার্থ অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো মহৎ কাজ সিদ্ধ হবে না। প্রধানমন্ত্রী এমন সতর্ক বার্তাও পৌঁছে দেন নারী সমাজের কাছে। সমতাভিত্তিক সমাজ আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রের পরম নির্দেশনা। কারণ যে কোনো সমসংখ্যক অংশ পিছিয়ে থাকলে উন্নয়নের সার্বিক গতিধারা পদে পদে হোঁচট খাবে। সেটা নারী-পুরুষ যেই হোক না কেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব শান্তি ও প্রগতির ওপর সমধিক গুরুত্ব দিয়ে সহিংস যুদ্ধকে পরিহারের উদাত্ত আবেদন জানান। তার মতে, অপ্রয়োজনে সংঘাত, বৈরিতা বারবার বিশ^কে উত্তপ্ত করে থাকে। সেখান থেকে সকলের সতর্কভাবে বের হয়ে আসা উচিত আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও উন্নত জগৎ তৈরির লক্ষ্যে। অন্যথায় স্বাভাবিকভাবে সামনে চলার পথ নিষ্কণ্টকও থাকে না। নতুন প্রজন্ম আর ভবিষ্যতে শান্তি শৃঙ্খলা সমৃদ্ধ উন্নত সমাজ উপহার দেওয়া উদ্ভূত পরিস্থিতির অপরিহার্য শর্ত। প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে পিছপা হলেন না মহামারি, রোহিঙ্গা সংকট এবং অতি আবশ্যিকভাবে পরিবেশ দূষণের ওপর যুগোপযোগী বক্তব্য দিতে। বর্তমান বিশে^র জলবায়ু সংকট আধুনিক শিল্পোন্নত দেশগুলোর নানা কর্মকান্ডের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। যথাযথ উদ্যোগে সেগুলোর লাগাম টেনে ধরাও এক দায়বদ্ধ কার্যক্রম। সেটা করতে ব্যর্থ হলে আগামীর পৃথিবী কোন্ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থানে চলে যাবে ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়। বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে তা সামলানো অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান বিশ্বে খাদ্য, অর্থায়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তাসমূহ সংকটের আবর্তে। তাকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে বিপদ আরও ঘনাতে সময় নেবে না।
বিশেষ করে ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে এবং হবে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। যারা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে। কার্বন নিঃসরণই পরিবেশ সংকটের মূল কারণ। কিন্তু অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া দেশগুলো কার্বন খুব বেশি নিঃসরণ করে না। অথচ পরিবেশ দূষণের ফলে সৃষ্ট বেশিরভাগ অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অসহায় উন্নয়নশীল দেশসমূহকেই। কাজেই যারা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে, তাদের অনেক দায়দায়িত্ব নেওয়ার অবকাশ থাকাও বাঞ্ছনীয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন ইতিবাচক ও সার্বিক উন্নয়ন প্রস্তাবনার প্রতি বাংলাদেশের নিঃশর্ত সমর্থন বরাবর ছিল, আগামীতেও এর অন্যথা হবে না। অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হওয়ার বিষয়টিও সবার নজরে এনে এর যথার্থ সমাধানে বৈশি^ক সহযোগিতাও জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানালেন, ৬ বছরে একজন রোহিঙ্গাও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হয়নি। শুধু কি তাই? মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আজও তা বন্ধ না হওয়ার চিত্র সত্যিই দুঃসহ। উন্নয়নশীল দেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে এগিয়ে নেওয়ার ওপর যথার্থ গুরুত্বারোপ করেন তিনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু কন্যার বাংলায় ভাষণ দেওয়ার বিষয়টি যেন তাঁকে পিতার সুযোগ্য সন্তানের সম্মানই জানান দিচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধের অবতারণার ওপর বার্তা দিতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে তাঁর পিতার নির্মম হত্যাযজ্ঞকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে হত্যাযজ্ঞ আজও বিশ্ব ইতিহাসের নির্মম রক্তাক্ত কলঙ্ক, যা স্বাধীনতা সূর্যকে অস্তমিত করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে লাল সবুজের পতাকাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও সপরিবারে পিতৃ হত্যার জ্বলন্ত আগুনে জীবনভর দগ্ধ হয়েছেন।
তেমন ক্ষতচিহ্ন আজও দগদগে ঘা হয়ে তাঁর অন্তরের নিভৃতে দাহ করে যাচ্ছে। দুই বোন বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান ঠিকই, কিন্তু অন্তর্জ্বালা ও সম্মুখ বিপদ কখনো পিছু ছাড়েনি। যা পিতৃহত্যার যন্ত্রণার মতোই নির্মম ও বেদনাদায়ক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্বিশেষে গণহত্যা ছাড়াও লাখো নারীর সম্ভ্রমহানিতার যে ইতিবৃত্ত তাও সকরুণ বেদনায় আজও কষ্টদায়ক অনুভব। ত্রিশ লাখ শহীদের পরম আত্মত্যাগ, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে কত পঙ্কিল অধ্যায় পার করতে হয় তাও ঐতিহাসিক নির্মম শোকগাথার করুণ আখ্যান।
সঙ্গত কারণে যুদ্ধ কিংবা সংকট নয়, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই হোক আগামী বিশ্বের যথার্থ পথচলা। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন এবং জলবায়ু সংকটের যথার্থ রূপরেখা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মহামারির প্রসঙ্গও উত্থাপন করেছেন। বৈশ্বিক একাত্মতায় করোনা মহামারিকে যে মাত্রায় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে তা অনন্য নজির। আগামীতেও যে কোনো মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটলে তাকে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা বৈশ্বিক সুস্থ পরিবেশের জন্য নিতান্ত আবশ্যক। তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনে বিশেষভাবে উত্থাপন করেন। এছাড়া বর্তমান বিশ্ব জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে যে মাত্রায় দুঃসহ বাতাবরণে আবর্তিত, সেখান থেকে বের হওয়ার যথার্থ পথ নির্দেশনাও জরুরি বলে মন্তব্য করেন।
গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ধরিত্রী বাঁচাও আন্দোলনে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সমূহ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করে উন্নত প্রযুক্তির লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, যারা অত্যধিক কার্বন নিঃসরণ করছে? তেমন উন্নত বিশ্ব যথার্থ ভর্তুকি দেবে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশসমূহকে- এমন যৌক্তিক দাবি আবারও নতুন করে উচ্চারিত হয় সদ্য সমাপ্ত হওয়া এই বিশ্ব অধিবেশনে। প্রকৃতি সহায়ক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দাবি বহু আগের। সেটি নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রতিও উন্নত বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহ কার্বন নিঃসরণ খুব বেশি করে না। তারপরও এসব দেশ ক্ষতির সর্বোচ্চ দূষণ মাত্রার শিকার হয়। এমন সংকট থেকে বের হতে তাদের যথেষ্ট আর্থিক সহায়তাও জরুরি, যা উন্নত বিশ্বকেই জোগান দেওয়ার কথা আগেও বলা হয়েছে, এবারও তার ন্যূনতম ব্যতিক্রম হয়নি।
লেখক : সাংবাদিক