ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৬ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২

মাদকের অপব্যবহার ও পাচার 

ডা. অরূপরতন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ২৫ জুন ২০২৩

মাদকের অপব্যবহার ও পাচার 

২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস

২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘People first : stop stigma and discrimination, strengthen prevention’ অর্থ হচ্ছে ‘মানুষকে প্রাধান্য দিয়ে কলঙ্ক ও বৈষম্য বন্ধ করুন, প্রতিরোধ জোরদার করুন’ অর্থাৎ মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের প্রতি বৈষম্য দূর করা ও সহানুভূতি দেখানো, যাতে করে তারা তাদের সমস্যাটির জন্য সহযোগিতা নিতে পারেন এবং সর্বোপরি প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদার করা যেতে পারে। মাদকাসক্তি বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান সমস্যারগুলোর মধ্যে অন্যতম।

মাদক শব্দটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষই বিচলিত হয় বা ভয় পায়, আর মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের ঘৃণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। আমাদের আশপাশে আত্মীয় পরিজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব যে কারও মাদকাসক্তি সমস্যার কথা জানলে তাকে সবাই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। এমনকি তার পরিবারকে বিভিন্ন অপবাদমূলক ও বৈষম্যমূলক আচরণ করে। যেমন : সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারকে অপমান করা, যোগ্যতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়াসহ বিভিন্ন নেতিবাচক আচরণ করা হয়। ফলে একজন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবারও অনেক সময় সমাজের এই সমস্ত নেতিবাচক আচরণের ভয়ে মাদক সমস্যা সমাধানের জন্য কারও কাছে সহায়তা চাইতে লজ্জা ও সঙ্কোচ করে থাকেন এবং এই সমস্যা সামনে নিয়ে আসতে চায় না।

ফলস্বরূপ সমস্যার তীব্রতা যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, তখন মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তির সমস্যার ধরন অনুযায়ী কি ধরনের চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন তা না বিবেচনা করেই চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে ভর্তি করেন, আবার কখনো বিয়ে দেয়া, তার ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারসহ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। গবেষণায় প্রমাণিত যে, অন্যান্য রোগের মতোই মাদক সমস্যা একটি রোগ। এই রোগকে বলা হয় ‘ক্রনিক রিল্যাপ্সিং ব্রেন ডিজিজ।’ সঠিক নিয়মে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে এ্যাভিডেন্স বেজড্ ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব এবং চিকিৎসা পরবর্তী নিয়মিত ব্যবস্থাাপনার মাধ্যমে সুস্থ থাকা সম্ভব। কিন্তু আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরাও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতায় সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না।

বাংলাদেশে বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোনো তথ্য না থাকলেও বেসরকারিভাবে বর্তমানে দেশে ১ কোটিরও বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। ৬০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কিছুদিন আগেও যারা ফেনসিডিলে আসক্ত ছিল তাদের অধিকাংশই এখন ইয়াবা আসক্ত। সাম্প্রতিককালে ইয়াবা আমাদের দেশের তরুণ-যুবসমাজকে গ্রাস করেছে। প্রতিদিন যেমন ইয়াবা চোরাচালান ধরা হচ্ছে তেমনি প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা তরুণরা গ্রহণ করছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মাদকাসক্তদের ৩০ শতাংশই শুধু নেশার খরচ জোগান দিতেই নানা ধরনের অপরাধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এসব জরিপে যে তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ও ভয়ের কারণ তা হচ্ছে, দেশে মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই কিশোর, তরুণ ও যুবক বয়সী। আর এই আসক্তির ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে ছাত্র এবং শিক্ষিত বেকারদের মধ্যে। আমাদের দেশে মহিলাদের মধ্যেও মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। এটা উদ্বেগের কারণ! নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। বাদ বাকি ৩৫-৪৫ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তদের শতকরা পাঁচজন নারী।

তাদের মধ্যে ছাত্রী, গৃহিণী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী রয়েছেন। মাদক সম্পর্কিত সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর একটি নতুন তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসার কারণে বাংলাদেশে বছরে পাচার হয় প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা : আঙ্কটাড (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) তাদের ওয়েবসাইটে অবৈধ অর্থপ্রবাহ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছে। 
ইয়াবাতে ম্যাথঅ্যামফিটামিন (এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান) থাকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আর আইসে ম্যাথঅ্যামফিটামিন থাকে ৯৫ শতাংশ। এটি অল্প পরিমাণে সেবনেও সাময়িকভাবে শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এ কারণে ইয়াবাসেবীরা ইয়াবা চেয়ে আইস সেবনে আগ্রহী হচ্ছে। ঢাকায় এক গ্রাম আইস বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়। উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে যারা মাদকসেবী, তাদের কাছে আইস বেশি জনপ্রিয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, যে পথে দেশের ইয়াবার চালান ঢুকছে, সেই একই পথে ঢুকছে আইস। জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে নৌ পথে নাফ নদী পেরিয়ে ৯০ শতাংশ আইস দেশে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অপ্রচলিত বিভিন্ন ধরনের মাদকও ধরা পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফেনইথাইলামিন, এলএসডি, ডায়মিথাইলট্রিপ্টামাইন বা ডিএমটি, ম্যাজিক মাশরুম, খাত (ইথিওপিয়ার উঁচু ভূমিতে জন্মানো এক ধরনের উদ্ভিদের পাতা), কুশ (মারিজুয়ানা প্রজাতির গাছ), এক্সট্যাসি, হেম্প, ফেন্টানিল, মলি ও এডারল। বিদেশে এসব মাদক প্রচলিত হলেও বাংলাদেশে অপ্রচলিত। 
মাদকের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সর্বাত্মক অভিযানের পরেও সীমান্ত পথে ইয়াবা আসা কমেনি। আইস বা ক্রিস্টাল ম্যাথ যেভাবে আসছে, তা সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, মিয়ানমারের অবস্থাান সহযোগিতামূলক নয়। বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা সহযোগিতা করছে না। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের মাদকচক্রের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। তাদের মাধ্যমেও মাদক আসছে, যা দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। হেরোইন, ফেনসিডিল, আফিম, মরফিন, নেশার, ইনজেকশন, গাঁজা, ভাং, মদ, তাড়ি, ঘুমের ওষুধ ইত্যাদি উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বহন-পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নিষিদ্ধ ও মারাত্মক অপরাধ।

এসব অপরাধ দ্রুত বিচার আদালতে বিচার্য এবং এ ক্ষেত্রে সাধারণত জামিন দেওয়া হয় না। মাদক অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্ছ মৃত্যুদ-। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন যেভাবে চলছে, তাতে মাদকদ্রব্যের এই অপব্যবহার ও মাদকাসক্তির কারণে দেশের উন্নয়নে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন অনেকেই। তাই, এই বাধা দূর করতে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলার কথা ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে মাদকসহ গ্রেফতারকৃতরা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে জামিনে ছাড়া না পায়, এ জন্য নানা ব্যবস্থাা গ্রহণ করছে সরকার।
করণীয় : ১. কেউ আসক্ত হলে গোপন না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন ২. মাদকাসক্ততে ঘৃণা না করে ভালোবাসা দেওয়া প্রয়োজন ৩. কেউ আসক্ত হলে স্বজন, বন্ধু, ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করা প্রয়োজন ৪. আসক্তির লক্ষণ দেখা দিলেই নিরাময় কেন্দ্রে যোগাযোগ করা এবং আসক্তকে ভালোবেসে তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। এখানে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈষম্য নয়, মাদকাসক্ত ও তার পরিবারের প্রতি বাড়াতে হবে সহযোগিতার হাত তবেই বাস্তবায়ন হবে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি। কারণ, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দ সৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র,
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থাা (মানস)
সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি (স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়) এবং
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স কমিটি (স্বাস্থ্যা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়) [email protected]

×