ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এটি আধুনিক যুগের বিশ্বযুদ্ধ নয় কি?

মমতাজ লতিফ

প্রকাশিত: ২০:৫২, ৩১ মে ২০২৩

এটি আধুনিক যুগের বিশ্বযুদ্ধ নয় কি?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘকালীন হবে- এ মন্তব্য ও আশঙ্কা রাশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের মুখে যেমন শোনা গেল

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘকালীন হবে- এ মন্তব্য ও আশঙ্কা রাশিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের মুখে যেমন শোনা গেল, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মুখেও শোনা গেল। আমরা যেসব দেশ এ যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, অস্ত্র-অর্থ দানকারী বা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের গোলাগুলির শিকার নই, কিন্তু বিশ্ববাজারে প্রধান দুটি প্রয়োজনীয় পণ্যÑ জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের জোগানদার ইউক্রেন ও রাশিয়ার খাদ্যশস্য ও জ্বালানি সরবরাহে বিঘœ ঘটার কারণে ভুক্তভোগী, তাদের জন্য এটি দুঃখজনক বার্তা। বিশ্বের সব দেশের মতোই আমাদের দেশে খাদ্য, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাধারণ ভোক্তার প্রায় নাগালের বাইরে।

বিশ্বায়নের যুগে যখন প্রতিটি দেশ অন্য দেশের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল তখন গম, চাল, গ্যাস, তেল আমদানিকারী দেশগুলোকে পড়তে হয়েছে চরম মূল্যস্ফীতির কবলে। উপরন্তু আমাদের শিল্পকারখানার জন্য পরিবহন ও গৃহস্থালি রান্নার কাজে এলএনজি আমদানি করতে হয়, সেটি ইউরোপ উচ্চমূল্যে কিনে নিচ্ছে। দেশের যে গ্যাস মজুত রাখা ছিল এতদিন, সে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়েছে। ফলে কারখানা ও গৃহস্থালিতে গ্যাস সঙ্কট দূর হবে বলে মনে হয়। তবে, যুদ্ধ বন্ধের আকাক্সক্ষায় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দু’দেশই পানি ঢেলে দিয়েছে। আমরা এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার অধিবাসীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার জন্য।

কেননা, বিশ্ব, বিশ্বের খাদ্য পণ্যসহ সবরকম পণ্য উৎপাদন এবং সরবরাহ চেনে যে বিপুল ব্যাঘাত ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এই যুদ্ধ। ২০২১-২২ করোনাকালে বিপুল মানুষ আয়হীন হয়ে পড়েছিল। সে অবস্থার পর আমাদের দেশে, অন্য দেশেও সরকার সে সঙ্গে জনগণ যথেষ্ট বিজ্ঞ, সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করে সে অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছিল যে সময়টিতে, তখনি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালায়, যখন ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ গণ্য করা খুব একটা ভুল হবে না। কেননা, অন্য দুটো বিশ্বযুদ্ধ প্রধানত ইউরোপেই সংঘটিত হয়েছিল, যাতে যুক্তরাষ্ট্র হিটলারের নাজি জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পুরো ইউরোপ-রাশিয়ার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্র-ধনিকতন্ত্র ইউরোপ একদিকে, অন্যদিকে রাশিয়ার পাশে সমর্থন দিচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বেলারুশ ও চীন। ভারত নিরপেক্ষ থেকে মাঝখান থেকে কম দামে রাশিয়ার তেল আমদানি করছে।
অস্ত্র বাদেও পুঁজিবাদী দেশের পণ্য বিক্রির বাজার ক্রমাগত বাড়াতে হয়, যা দেখা যায় করোনার টিকা বিক্রয় ও ক্রয়ের রাজনীতির বেলায়। সোজা কথা, আমাদের গার্মেন্টস পণ্য কিনবে না যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ, যদি আমরা তাদের উদ্ভাবিত ও প্রস্তুত কোটি কোটি ডোজ করোনা টিকা না কিনে নিজেদের টিকা নিজেরা তৈরি করি! কত কঠিন এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা- ভাবলেও বিস্মিত হতে হয়। অথচ করোনা টিকা দরিদ্র-ধনী সবারই প্রয়োজন, সর্বজনীন প্রয়োজন। বর্তমানে যেমন অস্ত্র ও পুঁজিবাদের প্রয়োজন হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সম্ভবত ‘আমার পণ্য, অস্ত্র হোক টিকা হোক, তুমি না কিনলে তোমার পণ্য গার্মেন্ট হোক, চামড়া হোক, চা হোক- আমি কিনব না’- এই নীতিটা পুঁজিতন্ত্র, বাজারের বিশ্বায়ন, নতুন ধরনের সা¤্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধকে বিস্তার লাভে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

ইউক্রেনে জেলেনস্কি যে পুঁজিবাদী ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রের বশীভূত পুতুল শাসক, যাকে এই যুদ্ধে টিকিয়ে রাখতে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। নতুন নতুন অস্ত্রের ব্যবহার ও  পরীক্ষাও চলছে এ সঙ্গে। যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে অতি উচ্চ মূল্যের অস্ত্র বিক্রি কমে যাবে। অথচ বর্তমানে পুঁজিবাদী দেশগুলোর মূল্যবান বিক্রয়পণ্য হচ্ছে- অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধবিমান, মিসাইল, ড্রোন ইত্যাদি। যুদ্ধের মাধ্যমে উন্নত সমৃদ্ধ দেশকে কিভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় তা বিশ্ব দেখেছে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার অংশ, আফগানিস্তান এবং ফিলিস্তিনে। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মারণাস্ত্র অ্যাটম বোমার পরীক্ষা চালানো হয়েছে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশুর হত্যার মাধ্যমে। বিশ্ববাসী ভাবেনি ঐ অভিজ্ঞতার পর আবার যুদ্ধ বাধবে, এবং তা হবে ইউরোপেই! 
এবারের যুদ্ধ পুঁজিবাদী বিশ্বের বিপরীতে সমাজতন্ত্র না থাকলেও যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে থাকা রাশিয়া নিজ দেশকে পুঁজিবাদী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর হাত থেকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে সীমান্ত দেশ ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থেকে ন্যাটোভুক্ত না হওয়ার জন্য চুক্তি করেছিল। যার বরখেলাপ করে একদিকে যেমন ন্যাটোকে বহাল রেখে দেওয়া হয়েছে, আবার ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার আবেদন করার ফল হচ্ছে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ। কিন্তু বর্তমানের পুঁজিবাদ যুদ্ধাস্ত্রকে প্রধান বাণিজ্য পণ্য করে তোলার ফলে এ যুদ্ধকে তত দীর্ঘ করা যায়, যত তাদের মুনাফা এবং তত রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র হ্রাস পাওয়া যা যুদ্ধ আনছে, শেষ পর্যন্ত কোনো বিজয় আনবে না।

ইউক্রেন যেহেতু ইউরোপের সীমান্তে অবস্থিত, সেহেতু সোভিয়েত আমলে এখানেই পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের স্থাপনা বেশি সংখ্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাশিয়ার জন্য তাই ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তি দীর্ঘমেয়াদি সব সময়ের জন্য অস্থিতিশীলতা, অরাজকতা, সংঘর্ষ তৈরির উৎস হয়ে থাকবে, যা রাশিয়ার জন্য চিরকালীন অশান্তির উৎস হবে। বহুকাল আগে কার্ল মার্ক্স লিখেছিলেন, ‘নিজেদের প্রস্তুত পণ্যের বাজারের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণিকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, সর্বত্র স্থাপন করতে হয় যোগসূত্র।’ আজকের দুনিয়া বিশ্বায়নের নামে জটিল জালে বন্দি ধনী-দরিদ্র সব দেশ। কেন আমরা খাদ্যপণ্যের বিভিন্ন মজুতদার-আমদানিকারক বা শস্যের মধ্য স্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটের কাছে বন্দি?

নতজানু? এমনকি সরকারও এদের কাছে অসহায় কেন? এটি পুঁজিাবাদী অর্থনীতির একটি অক্টোপাসের অসংখ্য-পা, যার বেষ্টনীর ভেতরে বন্দি থেকে সাধারণ ভোক্তা নিষ্পেষিত হয়। কেন পণ্যব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সরকার ভাঙতে পারে না? আজকে একজন পণ্য মজুতদারকে শূলে চড়ালে কালকে থেকে তাদের পুরো দল বা সিন্ডিকেট বাজারকে পণ্যশূন্য করে দেবে। মনে হতে পারে তা হবে কেন? দোষীদের দ- তো সরকারই দেবে। কিন্তু ওদের মধ্যকার সেই কঠিন দৃঢ় যোগসূত্র তৈরি করে দেয় পুঁজিবাদ, যার মুনাফার লোভ বড় পুঁজির মালিকদের সমিতি বা সংস্থার মাধ্যমে দৃঢ় ও অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন তৈরি করে। এটি এমন যে, একজন পণ্য আমদানিকারক বা মজুতদার একাই তার পণ্যের দাম কমাতে পারে না। ‘সমিতি’ বা সিন্ডিকেটের বাইরে সিদ্ধান্ত নিলে সে জাতচ্যুত হবে।

অন্যরা তার পণ্যের বাজারজাতকরণে হাজারো সমস্যা তৈরি করবে। সরকারকে শেষ পর্যন্ত সরকারি সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে টিসিবির মতো সংস্থার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে পণ্য আমদানি করতে হয় বাজারে পণ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে। উৎপাদককে ভর্তুকি দিয়ে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হয়। সরকারের ক্ষমতা থাকলেও পণ্য মজুদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে কিছু করতে পারে না। 
গরিবের ভাতা বৃদ্ধি করে তাদের ভাতা, বৃত্তির টাকা মোবাইলের মাধ্যমে পাঠানোর ফলে ঐ অর্থ এখন চুরি হয় না। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে স্কুলের বৃত্তি, বিধবা-বয়স্ক ভাতা থেকে অবসরপ্রাপ্তদের বেতন-ভাতা সহজে বিনা ঝুঁকিতে সবার হাতে হাতে, অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছে। কিন্তু ব্যাংক-ইন্সুরেন্স, রাস্তা-ব্রিজ তৈরি, নদী খনন, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি বড় প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট। অর্থ পাচারও চলছে।
পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বে কিছুটা স্বস্তিতে আছি। যেহেতু আমরা খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ম্ভর। যদিও তেল, চিনিতে দেশ এখনো আমদানিনির্ভর। তাই দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদের সংকট সবসময় সঙ্গী হয়। অতি উৎপাদন বাজার না পেয়ে মূল্য হারায়। আবার পুঁজির মালিকরা শ্রমিকের শ্রম শোষণ করে যে মুনাফা লাভ করে, তা বাজার না পেলে বাজার ভেঙে পড়ে। কোম্পানি দেউলিয়াও হয়। তাহলে কারখানা বন্ধ হয়, শ্রমিক চাকরি হারায়, আয় হারায়। ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ী অতিরিক্ত ঋণ নিয়ে সে অর্থ ব্যবসা বা কাজে না খাটালে ব্যাংক ফেল করে। যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে! ক্রেডিট সুইসের শেয়ার মূল্য কমে গেছে। বিশ্ব এক ধরনের মন্দায় ভুগছে, যেটি পুঁজিবাদের ভেতরেই নিহিত আছে।

সব দেশই নাগরিকদের কল্যাণ ভাতা, বিশেষ ভাতা দিয়ে, ভর্তুকি দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে অর্থনীতি পরিচালনা করছে। অক্সফ্যামের এক প্রতিবেদন বলেছে, ‘পৃথিবীর ১ শতাংশ ধনী সাধারণ মানুষের ৯৯ শতাংশ সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পত্তির অধকারী’। পুঁজিবাদ ভাতা, ভর্তুকি মানে না। কিন্তু কোভিড শেষে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সব পুঁজিবাদী দেশকেই ভর্তুকি বা ভাতা দিতে ও বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। পেশাজীবীদের ধর্মঘট, আন্দোলন- এসবও মজুরি বৃদ্ধির জন্য করা হচ্ছে। 
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই শতকের তরুণদের অধিকাংশ পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। মার্কস-এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘কোনো দেশ মুক্ত হতে পারে না, যদি সে অন্যদেশকে শোষণ করে।’ এ বিশ্বাসে বিশ শতকে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এত বিদ্রোহ, লড়াই, বিপ্লব এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়েছিল। আসলে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী দেশকেও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা-ভর্তুকি, ভাতা, বৃত্তি, রেশন বা পেনশন দিয়ে বিদ্যমান মহামন্দাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শুরুতেই টিসিবি, কসকর করে দরিদ্র, মধ্যবিত্তদের টিকে থাকতে সহায়তা করেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাই করে চলেছেন।
লেখক : শিক্ষাবিদ

×