ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ মার্চ ২০২৩, ১১ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

এবারের বইমেলা

শেখ আতাউর রহমান

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

এবারের বইমেলা

এবারের ফেব্রুয়ারির বইমেলা মহাসংকটে পড়েছে যে, কাগজের সীমাহীন উচ্চমূল্যে

ডি এল রায়ের গানটা আমরা সবাই শুনেছি- ‘ওই মহাশূন্যের ওপার থেকে কি গান ভেসে আসে.......!’-এই গানটির কথা ও সুর মনে গুঞ্জন তুললেই বই নামক বস্তুটির কথা ছলকে ওঠে বুকের ভেতর। কোনো প্রিয় বইয়ের প্রিয় মুখ দিব্য চোখে দেখতে পাই। বইয়ের মধ্যেই মহাশূন্যের কলধ্বনি শুনি! সেই কলধ্বনি ঘরের চার দেয়াল ভেদ করে দিগন্ত থেকে ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তে। (‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে!’-রবীন্দ্রনাথ)। বইয়ের মানুষগুলো তখন প্যানোরমার মতো আমার ত্রিনয়নে সচল হয়ে ওঠে। 
অপু-দুর্গার সঙ্গে আমিও কাশবনের ভেতর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে চলন্ত ট্রেনটা দেখি- সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সুদূরে মিলিয়ে যায় সেই অলৌকিক ট্রেন! সে যে কি রোমাঞ্চকর অনুভূতি শুধু অপু-দুর্গা নয়, ওদের সঙ্গে মুহুর্মুহু রোমাঞ্চিত হই আমিও! সেই সুদূর বাল্যকালে বয়স যখন আমার ১২/১৩- পাবনা জিলাস্কুলে পড়ি-‘দেবসাহিত্যকুটির’এর লাল রেক্সিনে বাঁধানো বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’-প্রতি অধ্যায়ের শুরুতে কালো উডব্লকের ছবিগুলো আমায় আজো টেনে নিয়ে যায় সুদূর অচিনপুরে, কোনো এক অচেনা ‘নিশ্চিন্তপুর’ গ্রামে।

(ইদানীং কেন জানি আমার মনে হয় উডব্লকগুলো কি সত্যজিৎ রায় এঁকেছিলেন? -নট আনলাইকলি! উডবার্ন লাইব্রেরীর সে বই- মা’র জন্য বাবার রেগুলার জোগানদারি। আর আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তা পড়ে ফেলি- ‘আমআঁটির ভেপু’Ñমা’র পড়ার ফাঁক-ফোকরে-কখনোবা ইস্কুল পালিয়ে। অতঃপর অপু-দুর্গা হয়ে ওঠে আমারও বন্ধু।
শঙ্খ কানে ধরলে নাকি সাগরের গর্জন শোনা যায়। পরখ করে দেখেছি এক ধরনের শনশন শব্দ হয় বটে, তবে তা সমুদ্রের গর্জনের মতো মনে হয়নি আমার! অথচ বই অর্থাৎ, বইয়ে বন্দী শব্দভা-ারের শব্দহীন কোলাহল আমার চৈতন্যকে  গ্রাস করে আজো! ওরহান পামুকের প্লেগাক্রান্ত (‘নাইটস্ অব প্লেগ’ সম্প্রতি প্রকাশিত) সেই অচিনদ্বীপে কেমন করে জানি আমিও হাজির হই এবং এক আত্মবন্দী রুগ্ন বাসিন্দার মতো ওই কনফাইন্ড দ্বীপে বসবাস শুরু করি।

আবার এমনি করে ‘মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যান্নালের মুখ ‘উড়ুক উড়ুক তারা রূপালী জ্যোৎস্নার ভেতরে উড়ুক!’। তখন মত্ত হই কোনো এক অচেনা অরুণিমা স্যান্নালের জন্য। খুঁজি তাকে হন্যে হয়ে বরিশালের জলেঘেরা গ্রামেগঞ্জেÑকুয়াকাটা যাবার পথে-প্রান্তরে। ‘অতসীমামী’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) যেমন করে স্বামীকে খুঁজে বেড়ান অচেনা রেলস্টেশনের আঁধারে ময়দানে। বললে বিশ্বাস করবেন না কখন যে আমি তার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছি ভূতগ্রস্তের মতো বুঝি না নিজেই। হাত বাড়িয়ে দিতেই অতসীমামী লোভীর মতো আমার হাতটি আঁকড়ে ধরেন ডুবন্ত নাবিকের মতো। তখন বলি, চলো মামী আমরা দুজনে মিলে খুঁজি ওকে। নিশ্চয়ই এখুনি দমকা হাওয়ায় ভেসে আসবে ওর ক্ল্যারিনেটের মিঠেসুর! 
অতঃপর? নাহ্ এখানেই থামি! বলবেন অবিশ^াস্য! মানুষটা কি ঠিক আছে? হ্যাঁ, বদনাম তো আছেই আমি কবি! প্লেটো’র ‘আইডিয়াল স্টেট’এ প্রবেশের অনুমতি নেই আমার! ফটকের কাছে ঘোরাঘুরি করলেই দারোয়ান ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে! বইয়ের আখ্যান লিখতে গিয়ে নষ্টালজিক হয়ে পড়ছি যে! ইন্টারমিডিয়েট পড়ি তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে। কিন্তু সে শহরে বাস করছি আমি একা নই,তিনজন- জয়তী ও ইমান (‘তৃতীয়ভুবন’: দ্বীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) আর আমি। অতঃপর বহুপরে ১৯৮১ থেকে ৮৩Ñটানা তিন বছর হন্যে হয়ে খুঁজেছি ওদের কলকাতার অলিগলিতে। পাইনি দেখা। পাবো কিভাবে? এইচ.জি.ওয়েলস’্ এর ‘টাইমমেশিন’ যে তখন বিকল আর উল্টো দিকে ঘোরে না সে! 
হায়, এ আমি কি করছি এতক্ষণ? ‘আনা’কে ভুলে বসে আছি? ক্ষমা কর লক্ষ্মীসোনা আনা, আমার সব থেকে দুঃখী বন্ধু আনা করেনিনা! বহু রাত খুঁজেছি তোমায়, আমার ‘রৌদ্রছায়া’র আস্তানার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া আঁধার রেললাইনের ওপর আনমনে হাঁটতে হাঁটতে, যদি পেয়ে যাই তোমার রক্তমাংস হাড়, সুদৃশ্য বহুমূল্য গাউনের কয়েকটি ছেঁড়া টুকরো যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল প্রায় দু’মাইল জুড়ে- না, পাইনি।

পেলে দেরাজে তুলে রাখতাম, ঘ্রাণ নিতাম, কাঁদতাম! আমার দুচোখ এখন ভিজে উঠেছে জলে! মানুষের দুঃখবোধ কি এতটা প্রগাঢ় হয়? সাহিত্যের দুনিয়ায় তোমার এমন আত্মহত্যা সেই প্রথম ও শেষ! সবাই তো যেতে চায় ব্যাংকক-পাতোয়া, ভারি মজা সেখানে- পশুর মাংস! মানুষের  মাংস! আমার আকাক্সক্ষা একবার যেতে চাই শুধু বরফে ঢাকা এ গ্রহের শীতলতম স্থান সায়বেরিয়ায়! ওখানে যে আমার জন্য অপেক্ষায় আছে দুজন, কাতিউশা (‘রেজারেকশন’: টলস্টয়) আর রাস্কলনিকভ (‘ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট’: দস্তয়ভস্কি), হায় কে নেবে আমায় সেখানে। ‘মানুষের জীবনের সফলতাগুলি কি বিফলতা? নাকি বিফলতাগুলি সফলতা?’ কোথায় যেন পড়েছিলাম। কিন্তু আজো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। 
আমার এসব সিজোফ্রেনিয়াক ভাবনাগুলোর উৎস যে কোথায় নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এতক্ষণ। তা হলো ‘শব্দকল্পদ্রুম’, অর্থাৎ শব্দবৃক্ষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সর্বকল্পনা! শব্দে আছে জ্ঞান, শব্দে আছে আনন্দ, আছে প্রেম-আছে হিংসা ক্রোধ। আবার শব্দেই রয়েছে অনন্তের হাতছানি! বই হলো একই সঙ্গে জ্ঞানবৃক্ষ-আনন্দবৃক্ষ। অর্থাৎ, মানব সভ্যতার প্রতীকই হলো বই বা গ্রন্থ।

আত্মবন্দী ভাবনাগুলোকে অমৃতের সন্ধান দেয় বই। বই যে মনোজগতের ‘জীবকোষ’-আরও গভীরে গেলে  ‘নিউক্লিয়াস’। সুরার পাত্র একসময় নিঃশেষ হয়, সাকীর দুচোখও ঢুলুঢুলু হয়ে আসে, তখন বেঁচে থাকে কেবল কাব্য-কবিতা!Ñযা অবিনশ^র! গুরু খৈয়াম, ঠিক বলছি তো? বই কিনে কেউ যে দেউলিয়া  হয় না- এটা আমরা সবাই জানি। সৈয়দ মুজতবা আলী অনেকদিন আগেই আমাদের তা জানিয়ে দিয়েছেন। অশেষ কৃতজ্ঞতা তাঁকে। সহৃদয় পাঠিকাপাঠক অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি আপনাদের।

এখন ‘এ কথা সে কথা দে বুড়ি পান পাতা!’ আর তাহলো এবারের ফেব্রুয়ারির বইমেলা মহাসংকটে পড়েছে যে, কাগজের সীমাহীন উচ্চমূল্যে এ মহান উৎসব প- হতে চলেছে বুঝি! প্রথিতযশা একজন প্রকাশকের (‘পাঠক সমাবেশ’) সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এমন অগ্নিমূল্যে কাগজ কিনে বই ছাপলে তা হবে একটা আত্মধ্বংসী ব্যবসায়িক বিপর্যয়। বইয়ের মূল্য দাঁড়াবে প্রায় তিনগুণ বেশি! তখন কে কিনবে এই মূল্যবান ‘কিতাব’?
অন্যদিকে প্রমথ চৌধুরীর কথাটাও স্মরণ করছি। সরস্বতীর ভা-ার শূন্য থাকলে লক্ষ্মীর ভা-ারও উজাড় হয়ে যায়। কারণ, তারা সহদোরাÑসৎবোন নয়! তাহলে উপায়? উপায় বোধকরি একটিইÑ আর তাহলো কাগজের ওপর সরকারের ভর্তুকি দেওয়া। সরকার চাল, ডাল, তেল, জ্বালানি-সবটাতেই ভর্তুকি দিচ্ছে। তবে কাগজে কেন নয়? বিশ^াস করি, যে সরকার বিশ^কে তাক লাগিয়ে বিশাল পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারে, সমগ্র বাংলাদেশকে কম্প্যাক্ট করতে পারে শত সেতু-সড়ক সংযোগ দিয়ে, সেই সরকার কি প্রকাশনা শিল্পের এমন দুরবস্থা উপেক্ষা করতে পারে? মোটেও তা নয়।

আমরা জানি প্রধানমন্ত্রী সাহিত্যমোদী। বই পড়েন, লেখেন, বই ভালোবাসেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প-সংস্কৃতির উৎসব একুশের ‘বইমেলা’ এবার প্রায় প্রাণহীন হয়ে পড়বে, সেটা হতে পারে না।  কেবল সরকারই পারে এই দুর্যোগ প্রতিহত করতে। সারাদেশের বইপ্রেমী, সাহিত্য শিল্পমোদীরা এখন সবাই তাকিয়ে আছে সরকারের দিকে। বর্তমান সরকারের আগে এমন একটা প্রাণহীন বইমেলা হবে, এটা অবিশ^াস্য! অগ্রহণযোগ্য। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় চার লাখ মানুষকে বাঁচানো হোক। তবেই বৃক্ষে বৃক্ষে ফুটবে কৃষ্ণচূড়ার ঝাড়! মহান এই সংস্কৃতিকে বাঁচান!  বার্নাড শ’ যথার্থই বলেছিলেন : ‘বই-ই হলো একটা জাতির ব্যারোমিটার!’


লেখক  : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান (অবসরপ্রাপ্ত), বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

monarchmart
monarchmart

শীর্ষ সংবাদ:

পুনরায় দূতাবাস চালু করছে সৌদি ও সিরিয়া
ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় আরাভ খান
বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে খাদে, নিহত ২
রাজধানীতে মাদকসহ গ্রেপ্তার ৭৪
এক্সপ্রেসওয়েতে গতিসীমা লঙ্ঘন করায় ৮৪ মামলা
লোকসভার সাংসদ পদ হারালেন রাহুল গান্ধী
বিএনপির আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ফখরুলদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই :ওবায়দুল কাদের
খুলনায় আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা
রাজা তৃতীয় চার্লসের ফ্রান্স সফর স্থগিত
সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত ১১
রাজধানীতে স্কুল শিক্ষিকার আত্মহত্যা
প্রথম দিনেই জমে উঠেছিলো রাজধানীর ইফতার বাজার
ক্যানসার ফাউন্ডেশন চালু করলেন সাকিব
রমজানে বিএনপির কর্মসূচি ঘোষণা
ভারতকে হারিয়েছে বাংলাদেশ