ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

রূপকল্প ২০৪১- ৪র্থ শিল্প বিপ্লব

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২

রূপকল্প ২০৪১- ৪র্থ শিল্প বিপ্লব

.

রূপকল্প-২০৪১ বা বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করে গড়ে তোলার জাতীয় কৌশলগত পরিকল্পনা। ২০২২ থেকে ২০৪৪ সালÑ এই বাইশ বছরের কৌশলগত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের লক্ষ্য শিল্পায়নের মাধ্যমে উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের প্রসারকে উৎসাহ দেওয়া রূপকল্প-২০৪১-এর মুখ্য উদ্দেশ্য।

খাতওয়ারী অন্যান্য সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলোÑ ১. মাথাপিছু আয় ১২,৫০০ ডলার (২০৪১ সালের মূল্যমানে ১৬,০০০ ডলারের বেশি), ২. দারিদ্র্য দূরীকরণ, ৩. ৯% জিডিপি প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা, ৫. বিনিয়োগ/ জিডিপি অনুপাত ৪৬.৯ শতাংশে বৃদ্ধি, ৬. রাজস্ব কর জিডিপির ১৫% পর্যন্ত বাড়ানো, ৭. রপ্তানি বৈচিত্র্য অর্জন, ৮. রপ্তানি আয় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি, ৯. গড় আয়ু বাড়িয়ে ৮০ বছর, ১০. মোট জনসংখ্যার ৭৫%-কে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, ১১. ২০৪১ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের সাক্ষরতার হার ১০০%-এ বৃদ্ধি, ১২. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ১%-এরও নিচে নামিয়ে আনা, ১৩. কর এবং ব্যয়ের নীতিমালা কার্যকর এবং ১৪.  অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক শক্তির বিকেন্দ্রীকরণ। উদ্দেশ্যগুলো সফল হলে দেশের মানুষ ভাগ্য উন্নয়নে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপান্তরের ফলে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং করে দেশের বেকার তরুণ-তরুণীরা ইতোমধ্যেই তাদের সক্ষমতার প্রমাণ করেছেন। আজ অনেকেই আমেরিকা-কানাডায় না গিয়েও নিজ ঘরে বসে আয় করছেন বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের অর্থনীতিতে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাই শিক্ষিত বেকার যুবকদের চাকরির পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট না করে উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়ন, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের আইসিটির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ২০৩০ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মডেল এসডিজি রাষ্ট্র গঠন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এটুআই প্রোগ্রামের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক ২০ ও ২১ নভেম্বর দেশব্যাপী ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা ২০২২ এবং উদ্ভাবনী অলিম্পিয়াড আয়োজন করে। মেলায় স্কুল শিক্ষার্থীরা ২০৪১ সাল উপযোগী স্মার্ট বাংলাদেশের মডেল  তৈরি করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেয়। সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ, ইন্ডাস্ট্রি ব্র্যান্ডিং, পলিসি সহায়তা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে ঘোষিত ‘রূপকল্প-২০৪১’ বাস্তবায়নে যৌথভাবে কাজ করছে সরকারের  সকল মন্ত্রণালয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, টেলিকমিউনিকেশন বিভাগ এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) দিয়ে যাচ্ছে তথ্য আদান-প্রদানের কারিগরি সহায়তা তথা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকেই হবে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ। সে লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট আরও চারটি ভিত্তি ঘোষণা করেছেন। সেগুলো হলোÑ ১. স্মার্ট সিটিজেন, ২. স্মার্ট ইকোনমি, ৩. স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও ৪. স্মার্ট সোসাইটি। 
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন-২০২১’-এর মূল ভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন। গত ১৪ বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক শহর থেকে গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অনলাইনে জন্মনিবন্ধন, অর্থ লেনদেন, ভর্তি ও চাকরির ফরম পূরণ, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, ইউটিলিটি বিল পরিশোধসহ হাজার রকম কাজ করতে পারছে অনায়াসেই। ডিজিটাল বিপ্লব বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের পর এখন চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যা আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে অর্থাৎ স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। 
বাংলাদেশের জন্য ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার সব থেকে বড় হাতিয়ার হলো তরুণ জনশক্তি। জ্ঞানভিত্তিক এই শিল্প বিপ্লবে প্রাকৃতিক সম্পদের চেয়ে দক্ষ মানবসম্পদই হবে বেশি মূল্যবান। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার জ্ঞান ও দক্ষতানির্ভর নানাবিধ কর্মক্ষেত্র। তাই ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হতে হবে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি। আর এজন্য প্রয়োজন হবে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে সংযোগ করতে হচ্ছে রূপান্তরিত শিক্ষা ব্যবস্থা। সে চিন্তাকে মাথায় রেখেই আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তিবান্ধব, কর্মোপযোগী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক একটি শিক্ষা কারিকুলাম প্রণীত হয়েছে, যা ২০২৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে। শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করার পরিবর্তে খেলা, বিনোদন এবং হাতে-কলমে শিখবে এবং দেশপ্রেমিক বিশ্বমানের মানবিক স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে ২০৪১ সালের আগেই। 
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এগুলো হলো- ১. অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, ২. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী বাহিনী সৃষ্টি এবং ৩. পরিবেশ সংরক্ষণ। তবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এতটাই যান্ত্রিক যে, মানুষের জন্য সেটি কিছুটা বিপজ্জনকও হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। মানুষের কর্মচ্যুতির পাশাপাশি প্রযুক্তির দাপট এমনই সম্প্রসারিত হতে পারে যে, মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় মানুষ একটু থমকে যেতে পারে। আজকে বিদ্যুৎচালিত মেট্রোরেল আমাদের জন্য যেমন যুগান্তকারী, ২০৪১ সালে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দাপটে তা হয়তো হবে সম্পূর্ণ চালকবিহীন, যা জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে চলছে বহু আগে থেকেই। কিংবা ইউরোপ, আমেরিকায় রোবট বা আইওটি দিয়ে শিল্প-কারখানা  পরিচালনা করা খুবই চমৎকার হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের জন্য অনেকটাই বেমানান। তবু আমাদের ডিজিটাল রূপান্তরের ভালো অংশটুকু গ্রহণ এবং ভয়ঙ্কর দিকটি পরিহার করে এগিয়ে যেতে হবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে সমান্তরালে। কারণ, এরপরই স্বাগত জানাতে হবে ৫ম শিল্প বিপ্লবকে, যা হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ভয়ঙ্কর দিক থেকে মুক্ত। মানবিক এই বিপ্লবে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা যেমন- ১. দারিদ্র্যহীন বিশ্ব, ২. ক্ষুধাহীন বিশ্ব, ৩. সুস্বাস্থ্য, ৪. উন্নত শিক্ষা, ৫. লিঙ্গ সমতা, ৬. সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, ৭. ক্রয়ক্ষমতায় থাকা ক্লিন অ্যানার্জি, ৮. সুকর্ম ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ৯. শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো, ১০. হ্রাসকৃত অসমতা, ১১. সাসটেইনেবল নগর ও প্রার্থী সম্প্রদায়, ১২. দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন, ১৩. জলবায়ুবিষয়ক কার্যক্রম, ১৪. জলজ প্রাণীর জীবন, ১৫. ভূমিতে বসবাসকারী প্রাণী, ১৬. শান্তি, বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ১৭. লক্ষ্য অর্জনে পারস্পরিক সহায়তা ইত্যাদির পূর্ণ নিশ্চয়তা থাকবে। অর্থাৎ ৫ম শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তি দিয়ে মানুষকে স্থলাভিষিক্ত না করে মানুষকেই প্রযুক্তির ব্যবহার উপযোগী করে তুলবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং তরুণ প্রজন্মের মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে জয় হবে রূপকল্প-২০৪১ এর। জয় হবে স্মার্ট বাংলাদেশের।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

×