ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিথ্যাচারের পটভূমি

শেখ রফিকুন্নবি সাথী

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৮ নভেম্বর ২০২২

মিথ্যাচারের পটভূমি

একটা লেখায় পড়েছিলাম, একজন গল্পকার অন্য মানুষকে সাহায্য করার জন্য গল্প তৈরি করে

একটা লেখায় পড়েছিলাম, একজন গল্পকার অন্য মানুষকে সাহায্য করার জন্য গল্প তৈরি করে। আর একজন মিথ্যাবাদী নিজেকে সাহায্য করার জন্য গল্প তৈরি করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য ইতিহাস নিয়ে নিজেদের মতো করে গল্প তৈরি করা এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা বিএনপির বহুদিনের অভ্যাস। এভাবেই তারা নিজেদের সাহায্য করার চেষ্টা করে আসছে। কিছুদিন আগে চ্যানেল আইয়ের একটা টকশোতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এক সময়ের শিক্ষামন্ত্রী এহসানুল হক মিলনকে বলতে শুনলাম, জিয়াউর রহমানের জন্যই নাকি আওয়ামী লীগ পুনর্জন্ম লাভ করেছে। ওই টকশোতে তার বিপরীতে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেনকে তিনি বারবার বলছিলেন বিষয়টি স্বীকার করে নিতে।
বাংলাদেশের ইতিহাস যে দলকে ছাড়া অসম্পূর্ণ, যে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জন্মলগ্ন থেকেই এদেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দলের শিকড় মানুষের হৃদয়ের গভীরে পৌঁছেছে, সে দলের পুনর্জন্ম হয়েছে একজন স্বৈরশাসকের হাতে- এরকম অযৌক্তিক কথা বলা বিএনপি নেতাদেরকেই মানায়।
১৯৭৬-এর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যখন রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার অনুমতি লাভ করে, তখন দেশে সামরিক আইনের আওতায় রাষ্ট্রপতি  এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি সায়েম। তার অধীনস্থ ছিলেন জিয়াউর রহমান। আফজাল হোসেন খুব যৌক্তিকভাবেই পাল্টা প্রশ্ন করেন, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যখন দেশ চালাচ্ছেন, তখন তার অধীনস্থ উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানকে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মের  ক্রেডিট দেওয়া মানে সত্য স্বীকার করে নেওয়া যে, ’৭৫-এর পর ক্ষমতায় যেই থাকুক সবই হতো জিয়াউর রহমানের ইশারায়। তাহলে ’৭৫-এর হত্যাকা-ের বিচার বন্ধে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের জন্য কেন জিয়াউর রহমানকে দায়ী করা যাবে না? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য এহসানুল হক মিলন এড়িয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগকে রাজনীতির সুযোগ দিয়েছেন জিয়াউর রহমান- এই কথাটা অবশ্য শুধু মিলন বলেছেন, বিষয়টা এরকম নয়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দ-প্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক রহমান থেকে শুরু করে বিএনপির সবাই এ কথাই বলে থাকেন। আসলেই কি বিষয়টা এরকম ছিল? নাকি ইতিহাসকে নিজেদের মতো করে সাজাতে, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এটাও হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকে অনুসরণ করে বিএনপির আরেকটা মিথ্যা প্রচারণা? যেরকম প্রচারণা তারা করেন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে।
তৎকালীন কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে আসলে জিয়াউর রহমান কি চেয়েছিলেন। ’৭৫-এর নির্মম হত্যাকা-ের পর দেশ যখন সামরিক আইনে চলছে, তখন ১৯৭৬-এর ২৮ জুলাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েম রাজনৈতিক দলবিধি জারি করেন। যেখানে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ৪ আগস্ট আগের জারিকৃত  নিয়মে কিছু সংশোধনী আনা হয়। কি ছিল সেই সংশোধনী? কেন আনা হয়েছিল? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ ছত্রভঙ্গ থাকলেও সংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত হলেও তিনিই ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রেরণা ও সাহসের উৎস। অপরদিকে, মৃত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন সামরিক সরকারের অস্বস্তি এবং ভয়ের কারণ।

এই ভয় থেকেই রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পাওয়ার নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। নতুন নিয়মে বলা হয়, কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে দল গঠন করা যাবে না। ৯ অক্টোবর ’৭৬-এ আওয়ামী লীগ যখন মুখবন্ধে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করে আবেদনপত্র জমা দিল, তার কয়েকদিন পরই আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি এলো, ‘ঞযব াবৎু ড়িৎফ ইড়হমড়নড়হফযঁ ংযড়ঁষফ নব ড়সরঃঃবফ.’ চিঠিতে বলা হলো, দাখিলকৃত দলিলপত্রের বক্তব্য ১৯৭৬-এর রাজনৈতিক দলবিধির ১০নং ধারার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এক্ষেত্রে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ রচিত ‘জেনারেল জিয়ার রাজত্ব’ গ্রন্থে উল্লিখিত একটা ঘটনার কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

‘বঙ্গবন্ধুর আমলে জাতীয় অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হওয়া শিক্ষাবিদ আবুল ফজল, যিনি পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা হয়ে ক্ষমতায় বসেন, তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরীকে সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে বলেন- ‘বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নীতি বাদ দিতে চাও না কেন? বাদ দিয়ে দলের অনুমতি নাও’। সাজেদা চৌধুরী স্পষ্টভাবে অসম্মতি জানালে আবুল ফজল বলেন, ‘এজন্যই তো জিয়া তোমাকে দেখতে পারে না।’ শুধু আবুল ফজল নন, প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমও সাজেদা চৌধুরীকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে একই প্রস্তাব দেন এবং জিজ্ঞেস করেন, চার অক্ষরের ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দে কি এমন আছে? কেন এই শব্দ নিয়ে এত জেদ। সাজেদা চৌধুরী উত্তরে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু’-এই চার অক্ষরের মধ্যেই বাংলাদেশ নিহিত।
যে বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগ এর নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, বাংলার মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যেই আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করেছেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন সেই বঙ্গবন্ধুর নাম আওয়ামী লীগ থেকে আলাদা করার অপচেষ্টা করে জিয়াউর রহমান কোন ফর্মুলায় আওয়ামী লীগকে পুনর্জন্ম দিতে চাইলেন, এই প্রশ্ন রাখলাম বিএনপির সকল নেতার কাছে।
এখানেই শেষ নয়। বঙ্গবন্ধু শব্দ বাদ দিয়েই আবেদন জমা দেওয়ার পক্ষে থাকা মিজানুর রহমান চৌধুরী গোপনে আলাদা আবেদন করলে সেটাও জমা নেওয়া হয়। এই গোপন খবর পেয়ে মহিউদ্দিন-সাজেদা গ্রুপ কৌশল অবলম্বন করেন এবং মুখবন্ধ ফাঁকা রেখে ঘোষণাপত্র এবং গঠনতন্ত্র জমা দেন। মুখবন্ধ ফাঁকা রাখা হয়েছিল প্রতিবাদ হিসেবে। যেখানে বঙ্গবন্ধু শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, সেখানে কিছু না থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। এরপর ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার অনুমোদন লাভ করে।

অনুমতি লাভের পর ২১ নভেম্বর ময়মনসিংহ থেকে প্রথম কর্মিসভা শুরু হয়, যা রূপ নেয় জনসভায়। পরবর্তীতে ২৫ নভেম্বর টাঙ্গাইলে কর্মিসভা হয়। এর পরপর ২৯ নভেম্বর সাধারণ সম্পাদক সাজেদা চৌধুরীসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার হননি মিজান চৌধুরী, মোল্লা জালাল প্রমুখ, যারা বঙ্গবন্ধু শব্দ বাদ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে।
আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করার চক্রান্ত হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আপোসহীন নেতৃবৃন্দকে জেলে পুরে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বাইরে রাখা হয় এবং জেলায় জেলায় কর্মী সম্মেলন করার সুযোগ দেওয়া হয়। অবশ্য ষড়যন্ত্র বেশিদূর এগোতে দেয়নি কর্মীরা। মিজান চৌধুরী গংকে কর্মীরা প্রশ্ন করল, অন্য নেতারা জেলে আর আপনারা বাইরে কিভাবে? এই প্রশের সদুত্তর মিজান চৌধুরী গংএর কাছে ছিল না। ৬ নভেম্বর ’৭৫-এ বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রথম ভাষণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ’৭৭ এর ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হবে।

কিন্তু জিয়াউর রহমান যখন বুঝতে পারলেন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগকে ঠেকানো সম্ভব হবে না, তখনই নির্বাচন বন্ধের ঘোষণা এলো। আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন রাষ্ট্রপতি সায়েম। আর এই ঘোষণার সমর্থক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় নামসর্বস্ব কিছু রাজনৈতিক দল, নির্বাচনে জেতার সামর্থ্য  যাদের কখনো ছিল না। যদিও রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন বিচারপতি সায়েম, কিন্তু প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি সায়েমকে জিয়ার নির্দেশ মেনেই চলতে হতো।
উপরোক্ত ঘটনাবলী বিবেচনা করে আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবন দিতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কেমন ছিল, তা মূল্যায়নের দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম পাঠকের ওপর। তবে হ্যাঁ,  পুনর্জাগরণ, পুনর্বাসন  জিয়াউর রহমানের হাতে হয়েছিল কিছু ব্যক্তি ও দলের। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করা জামায়াতের কতিপয় ব্যক্তি, দল এবং বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্র। যে পুনর্বাসনের কুফল থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ।

লেখক : রাজনৈতিক কর্মী

×