ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ

বিদেশে শারদ উৎসব

অজয় দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: ২০:৪০, ৩ অক্টোবর ২০২২

বিদেশে শারদ উৎসব

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনিতে চলছে জমজমাট শারদ উৎসব। ছাব্বিশ বছর আগে যখন আসি তখন সাকল্যে তিন-চারটে দুর্গাপূজা হতো এই শহরে। এখন পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ লেখা যখন লিখছি তখন সবে ফিরলাম একটি পূজা দেখে। ধার্মিক বা নিষ্ঠাবান কি-না জানি না, তবে কিছু আচার আর নৈতিকতা মেনে চলি। যে ধর্মে জন্ম নিয়েছি, বড় হয়েছি তার প্রতি শ্রদ্ধা থাকাটাই স্বাভাবিক। সব সময় মনে হয় নৈতিকতাই বড় ধর্ম। সে দৃষ্টিকোণে দুর্গাপূজার বড় নৈতিক দিকটি হচ্ছে নারী শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা। এই পূজায় পূজিত মা দুর্গা হচ্ছেন অশুর নামের অসুভ শক্তি দমনের দেবী। অসুরকে কোন দেবতা মোকাবেলা না করে দেবী কেন করলেন? এই প্রশ্নের উত্তরেই বোঝা সম্ভব নারী শক্তির প্রতি হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস বা আস্থা কতটা।
যে কথা বলছিলাম, সিডনিতে এখন নয় নয় করে দুই ডজনের কাছাকাছি পূজা হচ্ছে। যে পূজা থেকে এসে এ লেখাটি লিখছি সেখানে মানুষের ভিড়ে পা রাখা মুশকিল। ভরদুপুরে দূর-দূরান্ত থেকে ড্রাইভ করে আসা মানুষের ভিড়ে সয়লাব পূজাম-প। হিমশিম খাচ্ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক আর আয়োজকরা। হাসিমুখে ভিড় সামলালেও এটা স্পষ্ট এভাবে চললে আগামীতে অনেক নিয়মের পরিবর্তন করতে হবে। যেমন- আমেরিকা, ইংল্যান্ডে টোকেন ছাড়া দুপুরের বা রাতের খাবার মিলবে না। এটা করতে তারা বাধ্য হয়েছেন। ভিড় সামলানো আর মানুষের ঢল সামলাতে এর বিকল্প ছিল না। সিডনিতে এখনও সেভাবে টোকেন প্রথা চালু হয়নি।

বাংলাদেশের বাঙালীর মূল শক্তিই হচ্ছে আতিথেয়তা। আমরা এমন এক জাতি যারা নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতে ভালবাসি। ঘরে চাল আছে না ডাল আছে সেটা বিবেচনায় না রেখেই আমরা অতিথি আপ্যায়ন করি। নাগরিক জীবনে কলকাতার মানুষ এতটাই আত্মকেন্দ্রিক যে, তারা আদর-আপ্যায়নে আমাদের মতো উদার হতে পারে না তেমন। সিডনিতে বাংলাদেশের বাঙালীদের বিশটি পূজার পাশাপাশি তারা করে দু-একটা। এমনকি বাংলা নববর্ষ,ভাষা দিবস বা সাংস্কৃতিক উৎসব কিছুতেই নেই তারা। যা কিছু বাঙালীর, তার দায়-দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি আমরাই।
সিডনির এবারের পূজা উৎসবের সূচনাতেই মন ভাঙ্গা একটি সংবাদ পেলাম। জনকণ্ঠের কিংবদন্তি সাবেক উপদেষ্টা সম্পাদক দেশবরেণ্য সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব তোয়াব খানের মৃত্যুতে প্রবাসের সুধীমহলেও বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। সিডনির মেলব্যাগ নামের এই কলামটি লিখতে শুরু করি ২০০২ সাল থেকে। যার মানে বিশ বছর ধরে এই কলামটি ছাপা হয়ে আসছে।
তোয়াব খান আমাদের দেশের সংবাদপত্র জগতের একজন দিকপাল। নানা ক্রাইসিস মোমেন্টে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মেধা সংবাদপত্রকে সাহস ও ভরসা জুগিয়েছে।

মনে পড়ে বিএনপি আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার দিন তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ব্যথিত ও জ্বলে ওঠা তোয়াব খান কতটা আঘাত পেয়েছিলেন তা পরদিন তখনকার জনকণ্ঠ দেখলেই বোঝা যায়। ওয়ান ইলেভেনের সময় জনকণ্ঠকে টার্গেট করে বিভিন্ন ফ্লোরে তালা ঝোলানোর সময়ও বাহিনীর লোকজন তোয়াব খানের সঙ্গে আচরণে ছিলেন সংযত। কারণ, তারা জানত তিনি কে এবং কি তাঁর ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন সে সময়েও আমার নেয়া শেখ রেহানার সাক্ষাতকারটি প্রথম পাতায় ছাপিয়ে দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মিডিয়া কি করতে পারে!

তোয়াব খানের চলে যাওয়া দেশের জন্য, মিডিয়ার জন্য কতটা অপূরণীয় ক্ষতি সে হিসাব করবে সময়। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, তাঁর প্রয়াণ বাংলাদেশীদের ভেতর বিষাদের কালোছায়া নামিয়েছে। বহু মানুষ দেশে-বিদেশে নীরবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর পাশাপাশি মনে মনে স্মরণ করছেন এই কৃতী মানুষটিকে।
বলছিলাম পূজা বা শারদ উৎসবের কথা। এই উৎসব দেশের মতো বিদেশেও বাঙালীর অন্যতম প্রাণের উৎসব। তাই দেশ ভাল থাকলে, উৎসব নিরাপদ থাকলে বিশ্ববাঙালীও নির্বিঘেœ পালন করতে পারে উৎসব। গত বছরের অঘটনের পর নানা ধরনের শঙ্কা আর ভয় কাজ করছিল মনে মনে। আনন্দ আর উৎসব কি তা মানে? এর কাজ হচ্ছে নদীর মতো বয়ে যাওয়া। বাঙালীর দুর্গাপূজা এখন আর হিন্দুদের পূজায় সীমাবদ্ধ নেই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তা হলেও মূলত এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে শিল্প-সংস্কৃতি ও জীবনবোধ। সে বোধের অন্যতম প্রতীক মা দুর্গা। যিনি একদিকে দেবী, অন্যদিকে নারী শক্তি বা উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের প্রমূর্ত প্রতিমা।
[email protected]

×