ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন

আলমগীর সাত্তার

প্রকাশিত: ২২:৪১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন

শেখ হাসিনা

লেখায় পুনরাবৃত্তি আমার খুব অপছন্দনীয় বিষয়। এরপরও বলব কিছু কিছু লেখার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন আছে। কারণ, অনেকদিন আগে কিছু লিখেছিলাম। সে লেখা হয়ত বর্তমান পাঠকের দৃষ্টিপথেই আসেনি।
শেখ হাসিনাকে নিয়ে অসংখ্য ঘটনার কথাই মনে পড়ে। তাই বুঝতে পারছি না, কোনো লেখার পুনরাবৃত্তি করব অথবা করব না। অসংখ্য ঘটনার মধ্য থেকে মাত্র দু’টি ঘটনার কথা বলব। তারপর বর্তমানের একটি ঘটনার বিষয় তুলে ধরব।
১৯৯৪ বা ১৯৯৫ সালের কথা। শেখ হাসিনা বেইলী রোডের বিরোধীদলীয় নেতার বাসা ছেড়ে দিয়ে ধানম-ির পাঁচ নম্বর রোডের বাসায় এসে উঠেছেন। রাত তখন নয়টা-সাড়ে নয়টা বাজে। ধানম-ি হয়ে আমি বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎই মনে হলো, শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে যাই।
শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার বারবার দেখা করার কারণ কি? আমি কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করে, আমার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের কথা বলিনি। হ্যাঁ, একবার করেছিলাম, সেটা পরে উল্লেখ  করব। আসলে তাঁর সঙ্গে দেখা করলে, কথা বললে, আমি বঙ্গবন্ধুর কিছু নৈকট্য বোধ করতাম।
আমি যখন ধানম-ির পাঁচ নম্বর রোডের বাসায় গেলাম, তখন বাসার নিচতলায় একজন ভদ্রলোকের দেখা পেলাম। তিনি বললেন, শেখ হাসিনা সকালবেলায় বাসা থেকে বেরিয়ে কক্সবাজারসহ দু’তিন জায়গায় মিটিং শেষ করে ঢাকায় ফিরেছেন। তারপর ধানমণ্ডির ১৩ নম্বর রোডের আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়েছিলেন। অল্প সময় আগে বাসায় ফিরেছেন। এরপরও তাকে বললাম, তাঁকে গিয়ে আমার নাম বলুন। ওই ভদ্রলোক বাসার দোতলায় গিয়ে ফিরে এসে আমাকে শেখ হাসিনার কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে ছোট একখানা ঘরে বসে শেখ হাসিনা টেবিলের উপর রাখা একটি ল্যাপটপে কিছু টাইপ করছিলেন।
আমাকে দেখে বললেন, ল্যাপটপ ব্যবহার করা শিখছি।
যে ভদ্রলোকটা আমাকে উপরে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি দু’কাপ চা এবং প্লেটে কিছু কেক নিয়ে আসলেন। কেক খেলাম, চা পান করলাম। আমরা কিসব কথা বলেছিলাম, তার বিন্দুবিসর্গও আজ এত বছর পর আর মনে করতে পারছি না। আমি শুধু তাকিয়েছিলাম শেখ হাসিনার দিকে। দু’তিনটা সভা-সমাবেশ করে প্রায় বারো ঘণ্টা পর বাসায় ফিরেছেন।

কিন্তু চোখে-মুখে তেমন কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। বরং সেখানে বিরাজ করছে গভীর প্রশান্তি। এই শক্তি তিনি কোথায় পান? এখন আমি প্রধানমন্ত্রীর সময় নষ্ট হবে বলে তার সাথে দেখা করি না। কিন্তু আপনজনদের কাছে শুনি, তিনি সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করেন। হয়ত এসব গুণাবলী তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জš§সূত্রেই পেয়েছেন। আমি আওয়ামী লীগের একজন পাতি নেতাও না। তবু আমার নাম শুনলে তিনি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতেন? এটা তাঁর ভদ্রতা। এই ভদ্রতা বাংলাদেশের আর কোনো নেতা-নেত্রীর মধ্যে আছে বলে আমার জানা নেই।
ওই দিন শেখ হাসিনার চেহারার গভীর প্রশান্তি আমার মনকেও স্পর্শ করেছিল। আমিও মনের মাঝে প্রশান্তি নিয়েই ফিরে এসেছিলাম বাসায়।

(দুই)
১৯৯২ সালে আমার বড় ছেলে ডা. অঞ্জন সাত্তার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এমডি ডিগ্রী অর্জন করে দেশে ফিরে এসেছেন। বাংলাদেশে তখন সব মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদলের একক প্রাধান্য। বর্তমানের বিএনপি দলের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. জাহিদ তখন ছাত্রদলের প্রধান। তিনি ঘোষণা করলেন, বিদেশ থেকে যারা ডাক্তারি ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের কোনো মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নশিপ করতে পারবেন না।

অথচ যারা ছাত্রদলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ তাঁরা সবাই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নি করতে সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। আমার ছেলে অনেক চেষ্টা করেও কোনো মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্নি করার সুযোগ পেল না।
অঞ্জন আমাকে বলল, বাবা, চলো হাসিনা আপার কাছে যাই। তিনি হয়ত একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। ছেলের কথামতো একদিন সকাল দশটায় বেইলী রোডে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ওখানে গিয়ে দেখলাম, বাসার সামনে অনেক গাড়ি। শেখ হাসিনা গৌরিপুরে একটি মিটিং করতে যাবেন। আওয়ামী লীগ নেতারা যারা তাঁর সঙ্গে যাবেন, তাঁরা বাসার নিচতলার হলঘরে বসে আছেন। শেখ হাসিনা, দোতলায় বসে আমেরিকার নির্বাচনের প্রজেকশন মিটিং দেখছিলেন। অঞ্জন এবং আমি নিচতলার হলঘরের অপেক্ষমাণ নেতাদের সঙ্গে বসলাম।
বেলা সাড়ে দশটায় শেখ হাসিনা উপর থেকে নিচে নামলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা নিজ নিজ গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। শেখ হাসিনা নিচে নেমে যখন সিঁড়ির গোড়ায়, তখন অঞ্জন আর আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অঞ্জনকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। (এরপর ১৮ পৃষ্ঠায়)  বললাম, শেখ রাসেল আর অঞ্জন এক সঙ্গে ঢাকার ইউল্যাব স্কুলে পড়ত।

অঞ্জন ছিল শেখ রাসেলের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। এরপর অঞ্জনের সমস্যার কথা তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, এক মিনিট অপেক্ষা করুন। এই বলে দ্রুত দোতলায় উঠে গেলেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে দুই প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে এসে অঞ্জনের হাতে তুলে দিলেন। বললেন, পরশু রাজবাড়ী গিয়েছিলেন। ওখানকার লোকজন তাঁকে অনেক মিষ্টি উপহার দিয়েছেন।
যাহোক, অবশেষে শেখ হাসিনা অঞ্জনের ইন্টার্নি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অঞ্জন এখন আমেরিকার মানদণ্ডেই একজন উঁচুমানের ডাক্তার।
আমি ভাবছিলাম, এতো লোক যেখানে উপস্থিত সেখানে তিনি মিষ্টির প্যাকেট আনতে না গিয়ে, অন্য কাউকে নির্দেশ দিলেও তো পারতেন। অন্য কেউ হলে অবশ্য তা-ই করতেন। তিনি তো অন্যের মতো না। তিনি তো অনন্যা। এই-ই হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা!
বর্তমানে শেখ হাসিনার বয়স ৭৫ বছরের কম না। এখনো তাঁর চেহারার উজ্জ্বলতা অবাক হওয়ার মতো। বিশ্ব নেতাদের মাঝে যখন তিনি বসেন, তখন তাঁর চেয়ে বয়সে ছোট নেতৃবৃন্দকে অনেক ম্লান মনে হয়। যখন বঙ্গবন্ধু অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের মাঝে দাঁড়াতেন, তখন তাঁকেও সবচেয়ে সুদর্শন এবং ব্যক্তিত্বশালী বলেই প্রতীয়মান হতো।
শেখ হাসিনার সম্পর্কে পুরানো দিনের অনেক কথাই মনে পড়ে। সেসব বাদ দিয়ে বর্তমান সময়ের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই লেখার ইতি টানব।

(তিন)
মাস দু’এক আগে ঢাকা ক্লাবে কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি সাধারণত আজকাল কোনো অনুষ্ঠানে যাই না। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ঐদিনকার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, অনেকদিন পর আবার কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের সাথে দেখা হবে।
ঐদিনকার অনুষ্ঠানে একটা স্টেজ বানিয়ে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। আমাকেও কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল।

প্রথমে আমি কিছু বলতে অস্বীকার করলাম। পেছনের দিকে আমি কর্নেল সাজ্জাদের সঙ্গে বসেছিলাম। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি কিছু বলবেন না? বললাম, আমি যা বলব তা সবার ভালো লাগার কথা না। কথাগুলো একটু শক্ত হবে।
সাজ্জাদ ভাই বললেন, আপনার সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না। আপনার তো কারো কাছে কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই।
যারা অনুষ্ঠানটি অর্গানাইজ করেছিলেন, তাঁদের কাছে গিয়ে বললাম, হ্যাঁ, আমিও দু’টি কথা বলতে চাই। তাঁদের অনুমতি নিয়েই আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললাম,
‘এখানে উপস্থিত সবাই একথা স্বীকার করবেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং অনুপ্রেরণা ছাড়া আমাদের এদেশ স্বাধীন হতো না। তাঁর জন্যই আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। প্রতিদানে তাঁকে আমরা কি দিয়েছি! তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছি। এমনকি ছোট্ট শেখ রাসেলকেও হত্যা করতে দ্বিধা করিনি। তাই, আমি বলব বাঙালিদের বিশ্বাস করবেন না।’ সেদিন আমার এমন বক্তব্যে কজন একমত হয়েছিলেন তা বলতে পারব না।
আমার ভালো নাম কাজী আব্দুস সাত্তার। আমার দাদার নামও ছিল কাজী আব্দুস সাত্তার। তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার। আমার দুই ফুফু ছিলেন খ্যাতিমান ডাক্তার। বড় ফুফু হলেন ডা. জোহরা বেগম কাজী। ছোট ফুফু ডা. শিরিন বেগম কাজী। আমার দাদা ছিলেন সার্জন অব ইন্ডিয়া পদবির ডাক্তার।
শেরে বাংলা ফজলুল হক ছিলেন আমার দাদির খালাতো ভাই। আমার দাদা বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে ভারতের মধ্যপ্রদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন এবং কংগ্রেস পার্টির রাজনীতি করতেন। একবার শেরে বাংলা ফজলুল হক মধ্যপ্রদেশে গিয়ে দাদাকে বললেন, আপনি এখানে বসে কংগ্রেস পার্টি করলে তো আপনাকে কেউ চিনবে না। তার চেয়ে বাংলা মুল্লুকে চলে আসেন। এখানে এসে রাজনীতি করলে আপনাকে মানুষ চিনবে। দাদা উত্তরে বললেন, আমি বাঙালিদের বিশ্বাস করি না। কোন্ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এমন কথা বলেছিলেন, তা আমার জানা নেই। তবে দাদির কাছ থেকে এমন কথা শুনেছি।
মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার পর আমার দুই ফুফু, এক চাচা (ড. কাজী আশরাফ মাহমুদ) বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। আমার দাদা যা বলেছিলেন, তাকে বলা হয় প্রিমনিশন (Premonition)।
আমার কাছে Door To Future নামের একখানা বই আছে। বইখানা পড়লে Premonition সম্পর্কে অনেক তথ্য পাবেন পাঠক।
একটি উদাহরণ দিয়ে Premonition বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলছি :
আমার বাসা তখন ছিল ঢাকার বকশীবাজারে। ক্যাপ্টেন আলমগীরের বাসা ছিল জিন্দাবাহার লেনে। প্রত্যেকদিন সকাল দশটায় আলমগীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর গাড়িতে করে আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ঢাকার তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিমানের পাইলট অ্যাসোসিয়েশন অফিসে নিয়ে যেতেন। একদিন, আলমগীর গাড়ি বাসার সামনে রেখে বেরিয়ে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি তৈরি হয়েই ছিলাম। আমার সঙ্গে আমার মাও বাইরে এলেন।

আমার মা ছিলেন খুব রক্ষণশীল। তিনি আমার কোনো বন্ধুর সামনেও আসতেন না। কিন্তু ঐদিন তিনি এগিয়ে গিয়ে আলমগীরের দুই কাঁধের ওপর হাত রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, বাবা, তোমার সামনে বিপদ আছে। একটু সাবধানে থেকো। পরে মা আমাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানীরা আলমগীরকে হত্যা করবে।
অথচ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেব বলে মাকে যখন বললাম, তখন তিনি আমাকে হাসিমুখেই বিদায় জানিয়েছিলেন।
আলমগীর সম্পর্কে মায়ের ভবিষ্যত বক্তব্যই হলো Premonition।

×