ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ আগস্ট ॥ নেপথ্যের কুশীলব কারা

মনজুরুল আহসান বুলবুল

প্রকাশিত: ২১:১১, ১৫ আগস্ট ২০২২

১৫ আগস্ট ॥ নেপথ্যের কুশীলব কারা

জাতির জনকের খুনে রাঙ্গা বাংলায় ঘাতকদের উল্লাস

দাবিটি অনেক দিনেরবিষয়টি জরুরী, ইতিহাসের স্বার্থেইকবিরা কি অন্তর্যামী হন? দেশের তখ্তে তখন লেবাস পাল্টে সেনাশাসকজাতির জনকের খুনে রাঙ্গা বাংলায় ঘাতকদের উল্লাস১৬ জুলাই ১৯৭৮ এক তরুণ ছড়াকার লিখেন : রক্তঝরার অভিষেকে বসেছিলে তখ্তে/তোমার মরণ হবেই বাবা/ এমনি ধারার রক্তে

মাত্র তিন বছরের মাথায় ছড়ার ছন্দ সত্য প্রমাণিত হলো১৯৮১-তে উল্টে গেল তখ্তরক্তের অভিষেকে যিনি তখ্তে বসেছিলেন রক্তেই তার পরিসমাপ্তিকিন্তু সুস্পষ্টভাবে জানা হয় না এই ক্ষমতায় যাওয়ার রক্তের সিঁড়িটি তৈরির ক্ষেত্রে নেপথ্যে কার কি ভূমিকা ছিলপদ্মায়, মেঘনায় অনেক জল গড়ায়জাতির জনকের হত্যাকা-ের বিচার হয়সময় লাগে প্রায় ১২ বছর

কিছু খুনীর ফাঁসি হয়েছে, কিছু খুনী পালিয়ে আছেকেউ কেউ এমন বলেন, এই হত্যাকা-ের বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি দায়মুক্ত হয়েছেআমি বলি শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতি যে অপরাধ করেছে তা থেকে এই জাতির কোনদিন মুক্তি নেইমুজিব হত্যার পাপের গ্লানি এই জাতিকে বয়ে বেড়াতে হবে অনাদিকালতবুও খুনের বিচারটা তো হয়েছেকিন্তু  হত্যাকা-ের বিচারটাও কি পুরোপুরি হয়েছে? জবাব হচ্ছে- নাপ্রকাশ্যে যাদের দেখি, সেই খুনীদের বিচার হয়েছে; কিন্তু এই হত্যা ও যড়যন্ত্রের নেপথ্যের কুশীলবদের বিচার আজও হয়নিএমনকি প্রামাণিক সত্য দিয়ে তাদের দায়ও নিরূপণ করা হয়নি

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিচারপতিগণের পর্যবেক্ষণ- খন্দকার মোশতাক আহমেদের কুমিল্লার দাউদকান্দির বাড়ি ও কুমিল্লার বার্ড থেকে ষড়যন্ত্রের শুরুএরই ধারাবাহিকতায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকা-হত্যাকা-টি যথেষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়েছেষড়যন্ত্রের চেহারা স্পষ্ট হয় সেনানিবাসের বালুর ঘাটেপঁচাত্তরের মার্চে যে ষড়যন্ত্রের শুরু তার চূড়ান্ত পরিণতি আগস্টে মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে

রায়ে এক সম্মানিত বিচারপতি বলেছেন- ষড়যন্ত্রের অকাট্য প্রমাণের প্রয়োজন নেইবিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলেই হবে যে, কোন ব্যক্তির কার্যক্রম, বিবৃতি ও লেখা অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্র করেছেকোন ব্যক্তি কথা বা কাজের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পারেসকল ষড়যন্ত্রকারীকে অভিন্ন উদ্দেশ্যে একমত হতে হবেআরেক সম্মানিত বিচারপতি বলেন- ‘দ-বিধির ৩৪ ধারায় অভিন্ন ইচ্ছার উপাদান হলো কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অপরাধমূলক কাজ করার জন্য কতিপয় ব্যক্তির মনের মিল

অভিমতে আরও বলা হয়- ‘আমরা কখনই নিশ্চিতভাবে জানব না দ-িতরা ছাড়া আর কে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের হত্যাকা-ে জড়িত ছিলতাই এ মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করা  প্রয়োজন

এসব অভিমত অনুসরণ করেই কয়েকটি খ-চিত্রে খুঁজে দেখার চেষ্টা দ-িতরা ছাড়াও এই হত্যাকা-ের নেপথ্যে কারা, কিভাবে জড়িতকাদের  অভিন্ন ইচ্ছার মনের মিলঅপরাধটি সংঘটনে ভূমিকা রেখেছে

সাংবাদিক এ এল খতিব তার বিখ্যাত হু কিলড মুজিববইয়ে লিখছেন- [১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সকালে] রেডিও স্টেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে মোশতাকের ভাষণের লিখিত কপি বিতরণ করা হয়কালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ ভাষণের কপিটি পড়ে তার প্রশংসা করেনজবাবে মোশতাক বলেন- আপনার কি মনে হয় এ ভাষণটি একদিনে লেখা হয়েছে?’

যে প্রশ্নের জবাব জানা জরুরী : কবে থেকে এই ভাষণের খসড়া প্রণয়ন শুরু হয়েছিল? কারা এই খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত? এই ভাষণের পরিকল্পনা আর ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের পরিকল্পনা একই সূত্রে গাঁথা, সন্দেহ নেই

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কয়েকজন সাক্ষীর বক্তব্যের কিছু অংশ তুলে ধরা যাককি বলছেন তারা, কার বা কাদের নাম বলেছেন সেদিকে নজর দেয়া জরুরী

লে. কর্নেল (অব.) আবদুল হামিদ (তখন ঢাকার স্টেশন কমান্ডার ছিলেন) : ১৪ আগস্ট বিকেলে জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল মামুন, কর্নেল খোরশেদ ও আমি টেনিস খেলছিলামতখন আমি চাকরিচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর নূরকে টেনিস কোর্টের আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে দেখি

জেনারেল সফিউল্লাহ আমাকে বলেন- এরা চাকরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার, এরা কেন টেনিস খেলতে আসে? আমাকে তিনি বলেন, ‘এদের মানা করে দেবেন এখানে যেন এরা না আসেখেলা শেষে আমি মেজর নূরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলতে আস?’ জবাবে নূর জানায়, জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে তারা এখানে খেলতে আসে

প্রশ্ন : একজন ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিশ্চয়ই সেনানিবাসের সাধারণ নিয়ম জানেনচাকরিচ্যুতদের সঙ্গে তার কিইবা সখ্য? কেন তিনি এদেরকে সেনানিবাসে খেলতে যাওয়ার অনুমতি দেন?

কর্নেল (অব.) শাফায়েত জামিল (৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার) : [১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকালে] আমি দ্রুত ইউনিফরম পরে মেজর হাফেজসহ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা দিইপথে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যাইঘটনা শোনার পর তিনি (জিয়া) বললেন, ‘সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ কিলড; ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপ হোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন

জাতির জনকের হত্যার খবর শুনে নির্বিকার একজন  ডেপুটি চীফ অব স্টাফের সংবিধান রক্ষার এই নির্দেশনা কি এতটাই সহজভাবে নেয়ার বিষয়? হত্যাকা-ের পর তার নির্বিকার ভূমিকা কি এটি প্রমাণ করে না যে, হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা ছিল?

মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ (ডিজিএফআই ঢাকা ডিটাচমেন্টের ওসি ছিলেন) : ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর একটি কর্মসূচী পাইডিজিএফআই থেকে আমাকে বঙ্গবন্ধুর পার্সোনাল বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়১৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় কয়েকটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়

কারা সেদিন এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল? তার সঙ্গে ১৫ আগস্টের  ঘটনার যোগসূত্রইবা কি?

জিয়াউদ্দিন বলছেন : আমি সেদিন [১৫ আগস্ট, ১৯৭৫]  সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে যাই।  দেখতে পাই রাষ্ট্রপতির রুমে বসে খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, জেনারেল সফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, এয়ার এবং নেভি চীফদ্বয়, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর আজিজ পাশা আলোচনারত

এই সময় বিভিন্ন দেশের রেডিও মনিটরিং নিউজগুলো খন্দকার মোশতাকের কাছে এনে দেয়া হয়তিনি সবাইকে পড়ে শোনান যে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আধঘণ্টা হতে এক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান সরকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়েছেএ সংবাদ শোনার পর মেজর ফারুক, মেজর রশিদ ও মেজর ডালিমকে উল্লসিত ও গৌরবান্বিত মনে হচ্ছিল

এই উল্লাসের সূত্র ধরেই দেশের বাইরের কুশীলবদের চেহারা উন্মোচন খুবই সহজ

মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ (সেনাপ্রধান) : ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল আমাকে চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়জিয়াউর রহমানকে টেলিফোনে যখন আমার দায়িত্ব পাওয়া ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত জানাইজিয়া তখন বলেন, ‘ওকে সফিউল্লাহগুড বাই’—- ‘আমি যখনই কোন অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে ব্যবস্থা নিয়েছি তখন ওইসব অফিসার জেনারেল জিয়ার নিকট শেল্টার নিয়েছে

একজন চীফ অব স্টাফের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাদের ডেপুটি শেল্টার দিচ্ছেন সেটিও কি কোন বড় চক্রান্তের আভাস নয়? চীফের কাছে শাস্তি পাওয়া কাউকে শেল্টার দেয়া তো সেনা শৃঙ্খলারও পরিপন্থী

লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের জবানবন্দী : ... তকালীন ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আমার বাসায় হেঁটে আসতেনতিনি পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন এবং এক সময় বলছিলেন, ‘তোমরা ট্যাংকটুংক ছাড়া দেশের আর খবরাখবর রাখো কী?’ আমি বলি, দেখতেছি তো দেশে অনেক উল্টা-সিধা কাজ চলছে

আলাপের মাধ্যমে আমাকে ইন্সটিগেট করে বলেছিলেন, ‘দেশ বাঁচানোর জন্য একটা কিছু করা দরকারএ নিয়ে মেজর রশীদের সঙ্গে দেশের অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে আলাপ-আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, একমাত্র শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্টে এনে তাঁকে দিয়ে পরিবর্তন করা ছাড়া দেশে পরিবর্তন ঘটানো যাবে নাএ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলাপ করার সিদ্ধান্ত হয়।  এপ্রিল মাসের এক রাত্রে তার বাসায় আমি যাইসাজেশন চাইলে তিনি [জিয়া] বলেন, ‘আমি কী করতে পারি, তোমরা করতে পারলে কিছু করো’... রশীদ পরে জিয়া ও খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন

মেজর রশিদ, ডালিম ও খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আলোচনা করে যে, বাকশালের পতন ঘটাতে হবে এবং প্রয়োজনে শেখ মুজিবকে হত্যা করতে হবে, নইলে দেশ ও জাতি বাঁচবে নাযৌক্তিকভাবে আমিও ধারণাকে সমর্থন করিখন্দকার রশীদ জানায় যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলে জিয়াও আমাদের সমর্থন দেবে১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে মিলিটারি ফার্মে নাইট ট্রেনিংয়ের সময় কো-অর্ডিনেশন মিটিং করে ১৫ আগস্ট ভোরে চূড়ান্ত এ্যাকশনের সিদ্ধান্ত হয়

১৫ আগস্ট ঘটনার পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চীফ অব আর্মি স্টাফ করার বিষয়ে সাইফুর রহমানের বাড়িতে মিটিং হয়জিয়া, রশিদ ও সাইফুর রহমান মিটিং করেনপরে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হবে, সাইফুর ও রশীদ মন্ত্রী হবে, ওই উদ্দেশ্যে জিয়াউর রহমানকে চীফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়

এই সাক্ষ্য থেকে কি স্পষ্ট হয় না যে, মূল খুনীদের নেপথ্যে কে, কিভাবে কাজ করেছেদেশ বাঁচানোর নামে একটা কিছু করা এবং তারা কে কি পেতে চান সেই বাটোয়ারার চিত্রও তো স্পষ্ট

লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদের স্ত্রী জোবায়দা রশীদের জবানবন্দী : মেজর ফারুক জেনারেল জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করত ছোটবেলা থেকেই।  একদিন রাতে মেজর ফারুক জিয়ার বাসা থেকে ফিরে আমার স্বামীকে জানায় যে, সরকার পরিবর্তন হলে জিয়া প্রেসিডেন্ট হতে চায়জিয়া নাকি বলে ইফ ইট ইজ এ সাকসেস দেন কাম টু মিইফ ইট ইজ অ্যা ফেইলর দেন ডু নট ইনভলব মি

শেখ মুজিবকে জীবিত রেখে সরকার পরিবর্তন সম্ভব নয়এর কদিন পর মেজর ফারুক আমার বাসায় এসে রশীদকে বলে যে, জিয়া বলেছে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব খুঁজতে হবে যে দায়িত্ব নিতে পারবেসে মোতাবেক রশীদ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে জেনারেল জিয়াউর রহমান রশীদের কাছে ঘোরাঘুরি করছিল যাতে তাকে চীফ অব আর্মি করা হয়১৬ অথবা ১৭ তারিখ  সাইফুর রহমানের গুলশানের বাসায় সাইফুর রহমান, আমার স্বামী ও জিয়ার উপস্থিতিতে জিয়াকে চীফ অব আর্মি স্টাফ করার বিষয় ঠিক হয়

কুশীলবদের কার কি ভূমিকা সেটি বুঝতে আর কিছু কি বাকি থাকে?

তাহের উদ্দিন ঠাকুর (বঙ্গবন্ধুর সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী) : ১৯৭৫ সালের মে বা জুনের প্রথম দিকে ঢাকার গাজীপুর সালনা হাইস্কুলে ঢাকা বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হযসালনাতে মোশতাক সাহেব সেনা অফিসারদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমাদের আন্দোলনের অবস্থা কী?’ জবাবে তারা জানায় যে, ‘বস সবকিছুর ব্যবস্থা নিচ্ছেনআমরা তার প্রতিনিধি। - ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট  খন্দকার মোশতাক বলেন, এ সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার জিয়া দুইবার এসেছিলেনতিনি এবং তার লোকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন

জানা দরকার বসটি কে? একজন ব্রিগেডিয়ার কেন তার সঙ্গে দুইবার দেখা করতে গিয়েছিলেনতাড়াতাড়ি কিছু করার জন্য কার বা কাদের এত তাড়া?

সীমিত পরিসরে কয়েকটি খ-চিত্র বিশ্লেষণে যা বের হয়ে এলো তাতে পরিষ্কার, ১৫ আগস্টের হত্যাকা-টি একটি রাতের ঘটনামাত্র নয়, কয়েকজন ঘাতকের কাজমাত্র নয়নেপথ্যে আছেন বহু কুশীলবদেশে ও দেশের বাইরেদেশী ও বিদেশী

এ তো গেল খুনীদের বিচারের সময়কার কথাযদি দৃষ্টি দেই একটু আগেইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে ১৫ আগস্টের নৃশংসতম হত্যাকা-ের বিচার করা যাবে না বলে খুনী মোশতাক একটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরএটিই সেই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল এই অধ্যাদেশটিকে সংবিধানের অংশ করে নেন সে সময়কার উর্দিখোলারাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান

এখানেই শেষ নয়, ১৯৯৬ সালের ১২ নবেম্বর যখন জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হলো তার বিরুদ্ধে রিট করেছিল খুনী কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের মা মাহমুদা রহমান ও আরেক  খুনী কর্নেল শাহরিয়ার রশীদ খানএই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের সময় বিএনপি ও জামায়াত সংসদ থেকে ওয়াক আউট করেছিলজাতীয় পার্টির এমপি এন কে আলম চৌধুরী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের আগে  জনমত যাচাই করার প্রস্তাব করেন

দেখা যাচ্ছে খুনী মোশতাকের সঙ্গে হত্যা পূর্ববর্তী ষড়যন্ত্র, হত্যা পরবর্তী পদ-পদবী ও শেষে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রাপিÍ, খুনের বিচার না করাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি, সংসদ থেকে ওয়াক আউট এবং বছরের পর বছর বিচার বিলম্বিত করার প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা দলের ভূমিকা সবই খুব স্পষ্ট

১৯৮০ সালের ১ আগস্ট সেই তরুণ ছড়াকার আবার বলেছেন :  পালাবে কোথায়? কি দিয়ে মোড়াবে, বসে থাকা অই তখতো/ তোমার গায়ে, ছোপ ছোপ অই জনক খুনের রক্ত/ থু থু দিই আজ, অভিশাপ দিই, তোর বংশের গায়ে/ জনম জনম ফাঁসি চাই তোর, জনক খুনের দায়েএই থু থু বর্ষণ চলছেই

১৫ আগস্টের ঘটনায় প্রত্যক্ষ কয়েকজন খুনীর সাজা হয়েছে মাত্রকিন্তু দেশের ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকা-ের নেপথ্যের সব কুশীলবকে আনতে হবে প্রকাশ্যেএমনকি তারা যদি মারাও গিয়ে থাকেন, ইতিহাসের সত্যের খাতিরে তাদের দায় ও অবস্থান নিরূপণ করতে হবেএজন্য প্রয়োজন একটি জাতীয় কমিশন গঠনআজ এটিই জরুরী দাবি

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

×