মহাসড়কে অপরাধ প্রতিরোধে করণীয়
মহাসড়কগুলো প্রতিনিয়ত সাধারণ যাত্রীর কাছে বিধ্বংস ও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ভ্রমণের আগে অনেকেই ভয়ে তটস্থ থাকেন- কখণ্ড কোন্ বিপদ সামনে এসে আঘাত হানে! নিরাপদ ও স্বস্তির ভ্রমণের কথা সকলেই প্রত্যাশা করে থাকেন। তথাপি দুর্ঘটনা বিশেষ করে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীকে। একটা সময়ে রাতেরবেলায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে কালেভদ্রে বাস ডাকাতির ঘটনা শোনা যেত। বর্তমানে হরহামেশা, নিয়মিত বিরতিতে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ও হীন কর্মকা- সম্পাদিত হচ্ছে। এও বলতে হচ্ছে, এসব ডাকাতির ঘটনা জনসম্মুখে না আসায় ভয়াবহতার সম্পূর্ণ চিত্র উঠে আসছে না। যেগুলো উঠে আসছে সেসব অনেকাংশে গা শিউরে ওঠার মতো।
সর্বশেষ যে ঘটনাটি সারাদেশের মানুষকে হতচকিত করেছে- সেখানে গণধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে এবং অপরাধীরা নির্বিঘ্নে কোন ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই অপকর্ম সম্পাদন করতে পেরেছে। ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে দোষীদের গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, একজন অভিযুক্ত এ ধরনের বাস ডাকাতির অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে এবং সারাদেশে মহাসড়কগুলোতে এ ধরনের অসংখ্য চক্র জড়িত রয়েছে। কাজেই বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সতর্ক অবস্থান গ্রহণ মূলত অপরাধীদের অপকর্ম প্রতিহত করতে সহায়ক হবে।
কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে চক্রের অন্যতম সদস্য রাজা মিয়াসহ সবাইকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এটা খুব স্বস্তির সংবাদ এবং তাদের প্রচলিত আইনে দ্রুত বিচারসহ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত তৈরি করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভিক্টিম নারীকে তার সাহসিকতার জন্য ধন্যবাদ দেয়াও জরুরী। কেননা অধিকাংশ ভিক্টিম লোকলজ্জার ভয়ে তাদের ঘটনা প্রকাশে বিরত থেকে পুলিশের নিকট সঠিক তথ্য প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে। এর ফলে প্রকৃত ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়।
ঘটনার সত্যানুসন্ধান না করলে আপনি যেমনিভাবে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারবেন না, ঠিক তেমনি ভিক্টিমের জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু এ ঘটনার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নির্ভয়ে, নিঃসঙ্কোচে বিচারের প্রত্যাশায় এবং এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি করার দুঃসাহস কেউ না পায়, সে ক্ষেত্রে তিনি মিডিয়ার সামনে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়ে আর্জি পেশ করেছেন। এর পরও আরও অন্তত দুটি স্থানে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে, যা দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।
যে কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে অপরাধের সুযোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে পরিকল্পিতভাবে যে সকল অপরাধ সংঘটিত হয় যেমন- ডাকাতি, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও অপরাধের সুযোগ মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ আমরা এমন একটি পরিবেশের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছি যেখানে অপরাধীর অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে নানাবিধ সুযোগের অবকাশ রয়েছে। অপরাধীরা সে সুযোগটিকে লুফে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে অপরাধটি সম্পন্ন করছে। তাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত থাকে এবং সে মোতাবেক তারা কাজ চালিয়ে নিয়ে অপরাধটি সম্পন্ন করে।
আপনি যদি সাম্প্রতিক ঘটনার উদাহরণগুলো দেখেন, তাহলে দেখবেন অভিযুক্তরা বেশ কয়েকটি স্পটে বাসে ওঠে। তারা পরিকল্পিতভাবেই পালাক্রমে বাসে উঠে বাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং বাসযাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে। শুধু তাই নয়, বাসে থাকা নারী যাত্রীদের তারা গণধর্ষণ করে এবং শেষ অবধি বাসটিকে রাস্তায় ফেলে রেখে পলায়ন করে। পরবর্তীতে স্থানীয় এলাকাবাসী যাত্রীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।
মহাসড়কগুলোকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব মূলত হাইওয়ে পুলিশের। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় স্পট বিবেচনায় পুলিশের নিয়মিত টহল থাকে। সে সকল টহল ও পুলিশী অভিযানের কারণে অপরাধীরা ওই সব এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপকর্ম সম্পন্ন করতে পারে না সহজে। যেসব জায়গা নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে অবস্থান করে সেখানে অপরাধীরা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এবং সাধারণ মানুষের নিকট ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে কারণেই রাতেরবেলায় যে এলাকায় পুলিশী টহল থাকে না কিংবা ডিউটি থাকলেও পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করে না, সে জায়গায়ই অভিযুক্তরা সুযোগ বুঝে কোপ মারে অর্থাৎ অপরাধ সংঘটন করে থাকে।
ঘটনার দিনে অপরাধীরা যে জায়গায় বাসটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কেউ ছিলেন না। সারাদেশে রাতেরবেলায় মহাসড়কগুলোতে হাইওয়ে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরী এবং নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর বাসগুলো চেক করার প্রয়োজন রয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গা অন্তর অন্তর চেক করার ব্যবস্থা থাকলে মহাসড়কে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা নিশ্চিতভাবে কমে যাবে।
বর্তমানে পুলিশের হটলাইন ৯৯৯ সেবাটি জনগণের মাঝে আস্থা ও স্বস্তির বার্তা নিয়ে এসেছে এবং অনেকেই এটি থেকে সুবিধা গ্রহণ করছে। কাজেই যাত্রীগণ যে কোন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে এ সার্ভিস থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারে। এ সেবাটি সম্বন্ধে প্রত্যেক বাসে বিজ্ঞাপনের ন্যায় বার্তা থাকা জরুরী। দূরপাল্লার বাসে যাত্রী ওঠানোর ক্ষেত্রে কাউন্টার ব্যতীত যাত্রী তোলা নিষেধ করতে হবে। কেননা, সক্রিয় গ্যাং সর্বদা অপরাধ করার চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে। এ পেশায় অল্প পরিশ্রমে অনেক বেশি লাভের সম্ভাবনা থেকে কোন কোন অপরাধী বেশ কয়েকবার অপরাধ করার পরে পুলিশের কাছে গ্রেফতার হয়ে জেল হতে ফেরত এসে আবারও আগের দুষ্কর্মে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।
এক্ষেত্রে তার যুক্তি হচ্ছে, ৫-৬ বার অপকর্ম করার পরে যেহেতু সে গ্রেফতার হয়, সেহেতু মামলা পরিচালনা ও অন্যান্য খরচাদি বাদ দিলেও তার লাভের হার বেশি থাকে এবং জেল থেকে বেরিয়ে আসার পরেও সে আবার আগের অপকর্মেই সম্পৃক্ত হয়। কাজেই অপরাধীরা অপরাধ করার আগে লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ কষেই অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে এবং সচরাচর দেখা যায়, ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণই বেশি হয়ে থাকে।
জননিরাপত্তা বিধানই মূলত পুলিশের কাজ। অর্থাৎ জনগণের জান ও মালের হেফাজত করাই হচ্ছে পুলিশের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মহাসড়কগুলোতে যাত্রী সাধারণের জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অনুমোদনহীন বাস রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিধিনিষেধ জারি করতে হবে এবং বাস চলাচলের শিডিউলের আপডেট তালিকা হাইওয়ে পুলিশের নিকট অবশ্যই জমা রাখতে হবে। অনুমোদনহীন অসংখ্য বাস-মিনিবাস রাস্তায় চলাচল করছে।
এ বাসগুলোর কোয়ালিটি তুলনামূলকভাবে নগণ্য এবং কম ভাড়ায় যাত্রীরা এসব বাসে যাতায়াত করে থাকে। এ বাসগুলোতে হরহামেশাই ডাকাতির ঘটনা ঘটে থাকে এবং এরা রাতেরবেলায়ও যেখানে-সেখানে থেকে যাত্রী তোলে বাসে। এ সুযোগটি অপরাধী চক্ররা কাজে লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন স্পট থেকে যাত্রীর নামে চক্রের সদস্যদের বাসে তুলে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। অভিযোগ আছে, বাসের ড্রাইভার, সুপারভাইজার ও সহকারীরাও এ ধরনের চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এ চক্রের সঙ্গে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। না হলে হাইওয়ে থেকে অপরাধ দূর করা যাবে না। একইসঙ্গে নিশ্চিত করা যাবে না যাত্রীদের নিরাপত্তা।
এ কথাও সত্য যে, হাইওয়ে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত, হাইওয়ে দুর্ঘটনা ও ডাকাতি নিয়ে অসংখ্য মামলা হাইওয়ে থানাতে লিপিবদ্ধ থাকলেও মামলাগুলো সহসাই আলোর মুখ দেখে না। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ঘাটতির বিষয়টিকে অনেকেই সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে থাকেন। আবার অনেকেই পুলিশের অপরিপক্বতাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। যাই বলি না কেন, সকল পক্ষেরই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের বিকল্প নেই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে। পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় হাইওয়ে থেকে অপরাধ দূর করার লক্ষ্যে বেশকিছু পরিষেবা গ্রহণ করা জরুরী। মহাসড়কগুলোতে হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে টহলের সময়কালও বাড়ানো জরুরী। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধাকেও আধুনিক করা আবশ্যক।
সড়ক-মহাসড়কগুলোতে স্ট্রিট লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কোন লাইট নষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্বরিতগতিতে লাইট বসানোর কাজটি করতে হবে। রাতেরবেলায় ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির অনুমতির কাগজপত্রাদি যাচাই-বাছাইও করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যাত্রী সাধারণকে পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, পুলিশের দায়িত্ব পালনের সময় বিরক্তি প্রকাশ করার কোন সুযোগ নেই।
পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে এবং নিয়মিত বিরতিতে ক্যামেরার ফুটেজগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ফরমাল এবং ইনফরমাল সিকিউরিটি সিস্টেমকে কার্যকর করতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রেডলাইট ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করতে হবে। বিভিন্ন সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে প্রাইভেট পর্যায়ে সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। মহাসড়কগুলোতে অপরাধ প্রতিরোধ এবং যাত্রীদের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা আবশ্যক। যাত্রীদের প্রতিও অনুরোধ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও যত্রতত্র স্টেশন ব্যতিরেকে গাড়িতে যাত্রী ওঠায় এমন পরিবহন বর্জন করা উচিত। না হলে যাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে সম্ভব হবে না।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়