ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জননী সাহসিকা- বঙ্গমাতা

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:৪৯, ৭ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ১১:৩০, ৮ আগস্ট ২০২২

জননী সাহসিকা- বঙ্গমাতা

তোফায়েল আহমেদ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯৩তম শুভ জন্মদিনে তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজাতির পিতার নাম স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী পরম শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন তাঁর প্রিয় সহধর্মিণীআমৃত্যু নেপথ্যে থেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পরম মমতায় বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছিলেন এই মহীয়সী নারীস্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোতে জাতির জনককে বাস্তবোচিত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত দিয়ে তিনি বাঙালীর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ায় অনন্য ও ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জন্মগ্রহণ করেনআজ তিনি বেঁচে থাকলে ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেনবঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের ১২টি বছর বঙ্গমাতা অপরিসীম দুঃখ-কষ্টে সংসার জীবন অতিবাহিত করেছেন৫৪তে তিনি ঢাকায় আসেন এবং গেন্ডারিয়ায় রজনী চৌধুরী লেনে বাসা ভাড়া নেন৫৪তে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু বন ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পানতখন গেন্ডারিয়ার বাসা ছেড়ে ৩ নং মিন্টু রোডের সরকারী বাড়িতে ওঠেনঅল্প দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ৯২-ক ধারা জারি করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেমাত্র দুই সপ্তাহের নোটিসে বঙ্গমাতাকে বাসা খুঁজতে হয় ও নাজিরা বাজারে বাসা নেন৫৫তে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দফতরের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেনএ সময় বঙ্গবন্ধু পরিবার ১৫ আবদুল গণি রোডের বাসায় ছিলেনএর কিছুকাল পর মন্ত্রিত্ব অথবা দলের দায়িত্ব গ্রহণের প্রশ্ন সামনে এলে বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দলীয় সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং বঙ্গমাতাকে বাসা বদল করতে হয়এবার বাসা নেন সেগুনবাগিচায়এ সময় বঙ্গবন্ধু টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন৫৮-এর ৭ অক্টোবর আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি হলে ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়এবারও বঙ্গমাতা পরিবার-পরিজন নিয়ে অসহায় অবস্থায় বাসা খুঁজতে থাকেন এবং সেগুনবাগিচায় নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে বাসা নেনপরে সেটি পাল্টে ৭৬ সেগুনবাগিচায় অপর একটি বাড়ির দোতলায় ওঠেনতখন বঙ্গবন্ধুর নামে ১৪টি মামলা৬১তে বঙ্গবন্ধু কারামুক্ত হয়ে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নেনবঙ্গবন্ধু পরিবার ৬১-এর ১ অক্টোবর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেনএই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ধানমন্ডি ৩২ নং-এর বাড়িটি হয়ে ওঠে বাঙালীর জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঠিকানাবঙ্গবন্ধু দলীয় নেতাকর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতোবঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যগণও তাই মনে করতেননেতাকর্মীদের বিপদ-আপদে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতোমমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী যে ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ছিল, সেই চেতনার আলোয় আলোকিত ছিলেন বঙ্গমাতা

স্মৃতির পাতায় সযতনে সঞ্চিত কিছু ঘটনা আজও আমার মানসপটে ভেসে ওঠে৬৯-এর গণআন্দোলনে বঙ্গমাতার অবদান সবসময় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করিএকটা সময় ছাত্রলীগ এবং আমাদের খুব কঠিন অবস্থা গেছেএমন দিনও গেছে আমরা ছাত্রলীগ অফিসের ভাড়া দিতে পারিনি১৯৬৬-৬৭ সালের একটি ঘটনা মনে পড়েশ্রদ্ধেয় নেতা প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, জনাব মজহারুল হক বাকী সভাপতিআমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ইকবাল হলের (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ভিপিআমি মোটরসাইকেল চালাচ্ছি, রাজ্জাক ভাই পিছনে বসাগন্তব্য আগামাসি লেনে অবস্থিত ছাত্রলীগের অফিসসেখানে যাবার পর বাড়িওয়ালা আমাদের ডেকে বললেন, ‘আপনারা এখান থেকে চলে যানতিন মাসের ভাড়া বকেয়া

আপনারা অফিস ভাড়া দিতে পারেন নাএখানে ছাত্রলীগের অফিস রাখা যাবে নাআমরা বাড়িওয়ালাকে সবিনয়ে অনুরোধ করলাম, দয়া করে আমাদের কয়েক ঘণ্টা সময় দেনতিনি আমাদের অনুরোধ রাখলেনতখন বঙ্গবন্ধুসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধআমরা সেখান থেকে ধানম-ি ৩২ নং-এ বঙ্গমাতার কাছে গিয়ে আমাদের দুরবস্থার কথা বললে তিনি রাজ্জাক ভাইয়ের হাতে ২০০ টাকা দিলেনএই ২০০ টাকা থেকে বাড়িওয়ালার ৩ মাসের ভাড়া বাবদÑ মাসিক ৬০ টাকা করেÑ১৮০ টাকা পরিশোধ করলামবাকি ২০ টাকা দিয়ে আমরা একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলামযখন গণআন্দোলন শুরু হয় তখন তিনি নিজে, আজ আমাদের যিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুÑ ইকবাল হলের (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সন্নিকটে শিক্ষকদের যে আবাসিক এলাকা, সেখানে গাড়িতে বসে থাকতেনআমাদের ডেকে আর্থিক সাহায্য এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেনবঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ওনার দেখা হতো, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে প্রাপ্ত দিকনির্দেশনা আমাদের বুঝিয়ে বলতেনখুব কঠিন সময়ে তিনি ছাত্রলীগও পরিচালনা করেছেন

১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ৬৯-এর গণআন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনসেদিন ডেমোক্র্যাটিক এ্যাকশন কমিটি তথা ডাক-এর মিটিং ছিল পল্টন ময়দানেওইদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেখানে বঙ্গবন্ধুর বিচারকার্য চলছিল সেখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেনগাড়ি চালিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত স্বামী শ্রদ্ধেয় ডক্টর ওয়াজেদ মিয়াবঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘আজ তুই পল্টনে বক্তৃতা করিসআমি বলেছিলাম, আমরা তো রাজনৈতিক দলের সভায় বক্তৃতা করি নাতখন তিনি বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকরা যেখানে বসা থাকবে তুই সেখানে থাকবিতোকে দেখলেই মানুষ চাইবেতুই বক্তৃতা করিসএকজন মানুষ প্রায় ৩৩ মাস কারাভ্যন্তরে বন্দী, অথচ তিনি যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে তাই হয়েছেজনসভা শুরু হলো, আমরা ছাত্রসমাজ গেলাম, সাংবাদিকরা যেখানে বসেন তার কাছাকাছি থাকলামডাক-এর সভাপতি ছিলেন নুরুল আমিনসভামঞ্চ থেকে নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব করা হলে জনসভার মানুষ সে-নাম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলমঞ্চ থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আমাকে মঞ্চে তুলে নিলেনবঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে ধারণ করে বলেছিলাম, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের প্রিয়নেতা আমাদের মাঝে ফিরে আসবেনউল্লেখ্য যে, আইয়ুব খান তখন সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন

প্রশ্ন উঠেছিল, গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া হবে কিনাআমরা বলেছিলাম, ‘যাওয়া হবেতবে নেতৃত্ব দেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাদের প্রিয়নেতা শেখ মুজিবএই পরিস্থিতি সামনে রেখে জনতার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া আপনারা কী গোলটেবিল বৈঠক চান?’ লাখ লাখ মানুষ গগনবিদারী কণ্ঠে বলেছিল, ‘না, চাই না, চাই নাইতোমধ্যে প্রিয়নেতাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে নেয়ার ষড়যন্ত্র চলছিলসেই বিষয়টিও জনতার সামনে তুলে ধরে প্রশ্ন রেখেছিলাম, ‘আপনারা কী শেখ মুজিবের প্যারোলে মুক্তি চান?’ মানুষ বলেছে, ‘না না, চাই নাতখন নেতৃবৃন্দকে আমরা বলেছিলাম, ‘নেতৃবৃন্দ, আপনারা যাবেনকিন্তু প্রিয়নেতা শেখ মুজিবকে ছাড়া আপনারা গোলটেবিল বৈঠকে বসবেন নাএটি ছিল প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যাওয়া-না-যাওয়া প্রশ্নে জনতার ম্যান্ডেটবঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোল টেবিল বৈঠকে নেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা হয়েছিলপাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী কাজী সাহাবুদ্দিন, নেভাল চীফ এ আর খানসহ আরও অনেকেই এসেছিলেনকিন্তু সে-সব প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে মুখ্য ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিববঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে পল্টনের মিটিংয়ে জনতার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘মানুষ তোমার সম্পূর্ণ মুক্তি চায়তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, তোমাকে প্যারোলে মুক্তি দেবার জন্যতুমি কোনদিন প্যারোলে রাজি হবে নাবাংলার মানুষ তোমার প্যারোলে মুক্তি চায় নাবাংলার মানুষ তোমাকে ছাড়া গোলটেবিল বৈঠক চায় নাতোমার সম্পূর্ণভাবে মুক্তি না হলে প্যারোলে মুক্তির কোন চেষ্টা যেন না হয়বঙ্গবন্ধু নিজেও প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যেতেন না

বঙ্গবন্ধুকে যখন প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন তিনি ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আমি মুক্ত মানুষ হিসেবেই গোলটেবিল বৈঠকে যাবতারপর ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে আটকাবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়সারাদেশে দাবানলের মতো আগুন জ¦লে ওঠে১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানী সেনারা বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্যআইন জারি রাখেআমরা সিদ্ধান্ত নেই সান্ধ্যআইন ভাঙব এবং শহরকে মিছিলের নগরীতে রূপান্তরিত করব২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা নগরীকে মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত করে সান্ধ্যআইন প্রত্যাহারে বাধ্য করিপরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে পল্টনের জনসমুদ্রে প্রিয়নেতা শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলায় আটক সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে আমরা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান করিজনরোষের ভয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় প্রিয়নেতাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে তাঁর বাসভবনে পৌঁছে দেয়া হয়দেশজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রিয়নেতাকে গণসংবর্ধনা জানিয়ে বঙ্গবন্ধুউপাধিতে ভূষিত করা হয়সৈয়দ নজরুল ইসলাম-তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল লাহোরে গিয়েছিলেন গোলটেবিল বৈঠকেকিন্তু তাঁরা শর্তারোপ করেছিলেন, ‘আমাদের দলের নেতৃত্ব দিবেন শেখ মুজিবুর রহমানযতক্ষণ তিনি না আসবেন, ততক্ষণ আমরা গোলটেবিল বৈঠকে বসব নাবঙ্গবন্ধুর জন্য গোলটেবিল বৈঠক অপেক্ষা করেছিল; ‘মুক্তমানবহিসেবেই বঙ্গবন্ধু সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং এটিই বাংলার মানুষ প্রত্যাশা করেছিলগণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও বঙ্গমাতার অবদান স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে

একটি কথা বারবার মনে হয়একজন নেতা কত দূরদর্শী যে, তিনি সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জানতেনকোন্ সময় কোন্ কথা বলতে হবে এটা তাঁর মতো ভাল জানতেন এমন মানুষ এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখিনিলক্ষ্য করেছি, বঙ্গবন্ধু জীবনে স্ববিরোধী বক্তব্য দেননিএকটি বক্তব্য দিয়ে পরে সেই বক্তব্য অস্বীকার করা বা বক্তব্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা তাঁর কোনদিন হয়নিযা তিনি বিশ্বাস করেছেন, ভেবেছেন, মনে করেছেন যে এটিই বাস্তবসম্মত, সেটিই বলেছেন সুচিন্তিতভাবেএকবার যা বলেছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও আপোসহীন থেকেছেনশ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতার কাছে শুনেছি, ’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতার আগে ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু অস্থিরভাবে পায়চারী করেছেন এবং ভেবেছেন কী বলবেন! বঙ্গমাতা বলেছিলেন, ‘তুমি এত চিন্তা কর কেন? সারা জীবন একটা লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করেছো, কারাগারে গিয়েছো, জেল খেটেছো, ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছোতোমার বিশ^াসী অন্তর থেকে যা ভাল মনে কর এই মিটিংয়ে তুমি তাই বলবাদেখবা মানুষ সেটাই গ্রহণ করবেতুমি এখন ঘুমাওবঙ্গবন্ধু তাঁর হৃদয়ে ধারিত গভীর বিশ্বাস থেকেই সেদিন বক্তৃতা করেছেনবঙ্গবন্ধুকে অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি ছায়ার মতো বঙ্গবন্ধুর নিত্যসঙ্গী ছিলেনকারাগারের রোজনামচা’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীবই দুটো লেখার পেছনেও রয়েছে বঙ্গমাতার অবদানউনি বঙ্গবন্ধুকে বারবার অনুরোধ করেছেন, খাতাপত্র সরবরাহ করে বলেছেন যে, কারাগারে বসে তুমি এসব লেখোঅসমাপ্ত আত্মজীবনীগ্রন্থের ১ম পৃষ্ঠার শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী” ‘আমার স্ত্রী যার ডাক নাম রেণুÑ আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিলজেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেনরেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিলতাই আজ লিখতে শুরু করলামবঙ্গমাতার অনুপ্রেরণায় তিনি লিখেছেনসেদিনের সেই পা-ুলিপি আজ বই আকারে দেশবাসীর হাতে তুলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাবঙ্গবন্ধু কখনো জন্মদিন পালন করতেন নাএ সম্পর্কে কারাগারের রোজনামচাগ্রন্থের ২০৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকীএই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করিআমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনদিন নিজে পালন করি নাইÑ বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকতএই দিনটাতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতেবঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতাকে খুব ভালবাসতেন, ভাল জানতেন ও সম্মানের চোখে দেখতেনবঙ্গমাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনে সুখ-দুঃখের সঙ্গীজাতির পিতার জীবনের কঠিন দিনগুলোতে বঙ্গমাতাই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ধরে রেখেছেনতখন দুটো সংগঠন ছিলএকটি আওয়ামী লীগ, অপরটি ছাত্রলীগ

কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগসহ অন্যান্য সংগঠন পড়ে হয়েছেআমরা যারা ছাত্রলীগ করতাম কোনো কাজে বঙ্গমাতার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আমাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছেনকঠিন দুঃসময়ের মধ্যেও আর্থিক সাহায্য করেছেনআমরা ৫ টাকা, ১০ টাকা, ১০০ টাকার কুপন নিয়ে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতামএমন দিনও গেছে কেউ ১০০ টাকা দিলে আমরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতামওই সময়েও বঙ্গমাতা সংগঠনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আমাদের কর্মকান্ড সচল রেখেছেন৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর যেদিন দেশ শত্রুমুক্ত হলো, সেদিন আমরা বিজয়ীর বেশে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে এলাম১৮ ডিসেম্বর আমি এবং আব্দুর রাজ্জাকÑ আমরা দুভাই হেলিকপ্টারে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করিচারদিকে জয় বাংলাজয়ধ্বনির আনন্দ, ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না! প্রথমেই ছুটে গিয়েছিলামÑ শ্রদ্ধেয়া বঙ্গমাতা, শেখ হাসিনা. শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলসহÑ বঙ্গবন্ধু পরিবার যেখানে বন্দী ছিলেন সেখানেবঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিলেন এবং শেখ জামাল দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলমুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গমাতাকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়নিশেখ মুজিবের স্ত্রীকে বাসা ভাড়া দিলে বাড়িওয়ালাকে পাকিস্তান আর্মি ধরে নিয়ে যাবেযদি-বা কষ্টে-সৃষ্টে পরিচয় গোপন করে বাসা ভাড়া পাওয়া গেছে, তা-ও আবার পরিচয় পাবার পর কয়েক ঘণ্টার নোটিসে সেই বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছেপরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গমাতাকে ধানমন্ডির ১৮ নং-এর একটি বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখেমহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বঙ্গমাতা কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন

দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী; তবু বঙ্গমাতা সরকারী বাসভবনে না, থেকেছেন ধানমন্ডির ৩২ নং-এর অনাড়ম্বর বাসভবনেবঙ্গবন্ধুর বাড়ির দরোজা ছিল সকলের জন্য উন্মুক্তসর্বস্তরের মানুষ যাতায়াত করতবঙ্গমাতা সকলকেই হাসিমুখে গ্রহণ ও বরণ করতেনবঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর খোঁজ নিতেন, সাধ্যমতো সহায়তা করতেনস্বাধীনতার পর যখন আমি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব প্রতিদিন সকাল ৯টায় ৩২ নং-এ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যেতাম, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনেএরপর রাত ৯টায় বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নং-এর বাসভবনে পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরতামযখন বঙ্গমাতার বাসায় যেতাম তখন তিনি আমাদের নিজ সন্তানের মতো যতœ করতেনবঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুর জন্য স্বহস্তে রান্না করতেনবঙ্গবন্ধুর সবকিছু গুছিয়ে রাখতেনবঙ্গবন্ধু বঙ্গমাতাকে রেণুবলে ডাকতেনবঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ছিলেন আদর্শ দম্পতি, আদর্শ যুগলবঙ্গবন্ধুউপাধি প্রাপ্তির ঐতিহাসিক জনসভায় জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে কারাগার থেকে আমাকে মুক্ত করেছো, যদি কোনদিন পারি নিজের বুকের রক্ত দিয়ে তোমাদের রক্তের ঋণ শোধ করে যাবোতিনি একা রক্ত দেননি, সপরিবারে রক্ত দিয়ে সেই রক্তের ঋণ শোধ করে গেছেন৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে ঘাতকের বুলেট যখন জাতির পিতার বক্ষ বিদীর্ণ করেছিল, সে-সময় চিকার করে ঘাতকের দলকে বঙ্গমাতা বলেছিলেন তাঁকেও মেরে ফেলতেজীবনসঙ্গীর মরণকালে চিরকালের জন্য তাঁর সহযাত্রী হয়েছেনজাতির পিতা ও বঙ্গমাতা বাংলার মানুষকে খুব ভালবাসতেনস্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে তাঁদের এই অকৃত্রিম সৃষ্টিশীল ভালবাসা অম্লান হয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবেজাতির পিতা ও বঙ্গমাতা সম্পর্কে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-

পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয়

স্থায়ী কমিটি

[email protected]

×