ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

অভিরাজ নাথ

কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব

প্রকাশিত: ২০:২৩, ১৫ নভেম্বর ২০২১

কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কর্মশালার প্রবেশের দ্বার অতিক্ষুদ্র, রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের ন্যায় ইহা অভ্রভেদী নহে; কিন্তু গৌরবের বিষয় এই যে, এখানে নিজের শক্তি সম্বল করিয়া প্রবেশ করিতে হয়, ভিক্ষাপাত্র লইয়া নহে।’ মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা একটি। আর এই শিক্ষা মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা শিক্ষাই মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উন্নতির ফলে কর্মসংস্থানের ধারণা দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। নতুন নতুন কাজের দ্বার উন্মোচন হচ্ছে। যার সঙ্গে বিশেষ শিক্ষা অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্বও বাড়ছে। কর্মমুখী শিক্ষার ধারণা মূলত পেশাগত কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই শিক্ষা এক ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীর কর্মদক্ষতা সৃষ্টি করে এবং শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী করে তোলে। কর্মমুখী শিক্ষা যান্ত্রিক শিক্ষা নয়। এর কাজ জনশক্তিকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজের শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কর্মমুখী শিক্ষা মূলত চতুর্মুখী নীতি নিয়ে আবির্ভূত। এগুলো হলো- জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে শিক্ষার্থীকে পরিচয় করানো এবং তার সুপ্ত গুণাবলীকে জাগ্রত করা। শিক্ষার্থীকে নৈতিক, সামাজিক এবং মানবিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করা। গণতন্ত্রমনা, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে তাকে গড়ে তোলা। কর্মক্ষমতা সৃষ্টি করে তাকে কর্মমুখী ও উপার্জনমূলক জনশক্তিতে রূপান্তর করা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সীমিত সম্পদের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শিক্ষিত বেকার ও তাদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বেড়েই চলেছে। পক্ষান্তরে, কর্মমুখী শিক্ষা এনে দিচ্ছে বিপুল সুযোগ আর অবারিত সম্ভাবনা। এতে রয়েছে আত্মকর্মসংস্থানের নানা সুযোগ, যা দারিদ্র্য দূরীকরণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কর্মমুখী শিক্ষা স্বাধীন পেশা গ্রহণে এবং স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে। তাই কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই কর্মমুখী শিক্ষার ওপর যত বেশি গুরুত্বারোপ করা হবে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তত ত্বরান্বিত হবে। এ শিক্ষার মধ্য দিয়েই দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব। বর্তমান বিশ্ব আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশল আবিষ্কার করছে অথচ আমরা এর থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিকল্পিত ও কর্মমুখী। কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ফলে আজ আমেরিকা, জাপান, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ নিজেদের জীবনমানকে সুপ্রসন্ন করেছে। তারা আজ কর্মের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলে নিয়েছে। এই বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে তারা আজ উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। আমাদের দেশ অনেক দিক থেকেই পশ্চাদপদ ও অনগ্রসর। বিশেষত, শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিক থেকে। তাই যথাযথ জ্ঞানের অভাবে দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। এটি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। দেশের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণীরাও এ শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না। এ ধরনের মানসিকতা দূর করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কর্মমুখী শিক্ষা যে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ ও উপকারী সেই সচেতনতা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। যা আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে অগ্রগতি ও উন্নতির অন্যতম নিয়ামক। অবশ্য বর্তমানে দেশে কর্মমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারণ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারী-বেসরকারী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এছাড়াও পলিটেকনিক ও ভোকেশনাল, গ্রাফিক্স আর্ট, লেদার ও টেক্সটাইল টেকনোলজি কলেজ, ভেটেরেনারি কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়াও হোটেল ব্যবস্থাপনা, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, উদ্যান পরিচর্যা, সূচীশিল্প, মুদ্রণ, মৎস্য চাষ, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন, কম্পিউটার চালনা, কুটির শিল্প প্রভৃতি ধীরে ধীরে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এতে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটছে। কর্মমুখী শিক্ষা ব্যক্তিগত অথবা জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের পেছনে কিছু সমস্যাও বিদ্যমান রয়েছে। যেমন- পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, লোকবল সংস্থান, শিক্ষার উপকরণ ও আর্থিক ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থার অভাব, গুণগত মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, সরকারী পদক্ষেপের অভাব। এক্ষেত্রে কর্মমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো, এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, শিক্ষার ব্যয় সংকুলানে অর্থ সংস্থানের পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি সরকারী পদক্ষেপকে আরও জোরদার করতে হবে। বর্তমানের তরুণ সমাজকে এই গঠনমূলক ও কর্মমুখী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহ সৃষ্টি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দরকার উপযুক্ত সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। দেশে কর্মমুখী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার এখনও ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা, লোকবল, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, আর্থিক ব্যয় সংকুলানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রকট সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ প্রয়োজন। লেখক : শিশুসাহিত্যিক [email protected]
×