ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২

চিকিৎসক সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা, বিনা মূল্যের ঔষধ পাচ্ছেন না রোগীরা

জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম

প্রকাশিত: ০০:১৫, ৬ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ০০:১৬, ৬ আগস্ট ২০২৫

চিকিৎসক সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা, বিনা মূল্যের ঔষধ পাচ্ছেন না রোগীরা

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর মেকুরের আলগার মেছাঃ মজিকা বেগম (৫৫) বুকে ও কোমরের ব্যথা নিয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন। তিনি বলেন, “আজকে লাইনে দাঁড়ায় টেহা দিয়া টিকিট নিয়া ডাক্তারের জন্য কতক্ষণ বইসা থাকি, ডাক্তার আসে না। পরে একজনে কইল, ডাক্তার বসবো না। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার নাই। আমাগো গরিব মানুষের চিকিৎসার কী হইবো? চিকিৎসার জন্য আইসা ঘুইরা যাইতে হয়। বাইরের ডাক্তার দেখানোর টেহা নাই। অহন বিনা চিকিৎসায় মরন লাগবো।”

পৌরসভার জোনাই ডাঙ্গা গ্রামের চা দোকানি জমির উদ্দিন (৮০) তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী জোবেদা বেগম (৬৭) ও নাতনি বিউটিকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তিনি বলেন, “টিকিট নিয়া কাউন্টারে গেলে কয়, ঔষধ নাই, বাইর থেইকা কিনে লন। গাঁওখান নারিও দ্যাখে না, ভাল করে শোনেও না। খালি একই বড়ি সবাইকে দেয়। পরে শুইনোং, এঁরা এমবিবিএস ডাক্তার না, এঁরা উপসহকারী মেডিকেল অফিসার—স্যাকমো। গরিব মানুষ টেহা দিয়া বড় ডাক্তার দেখপার পাই না।”

ফকিরের হাট গ্রামের রয়েল মিয়া (২৫) বুকে ব্যথা নিয়ে পুরুষ ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে দুই দিন ধরে ভর্তি। তিনি বলেন,
“এখানে কোন চিকিৎসা নাই। সব ঔষধ বাইর থেইকা কিনে আনতে হয়। গরিব মানুষ ঔষধ কিনতে পারি না। এখানে থাকি কোনো লাভ নাই।”

২১ জুলাই, সোমবার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেল আউটডোরে রোগীদের ব্যাপক ভিড়। ডাক্তারদের বসার জন্য ১০৩, ১০৬, ১০৭ ও ১০৯ নম্বর কক্ষ থাকলেও কোথাও কোনো ডাক্তার নেই। কেবল দুইটি কক্ষে উপসহকারী মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) আনোয়ারুল ইসলাম ও মামুন ইসলাম রোগী দেখছেন।

স্যাকমো মামুন ইসলাম বলেন, “মেডিকেল অফিসার না থাকায় আমাদের ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে প্রেষণে এনে আউটডোর রোগী দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিতে পারি না। জটিল রোগী এলে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে প্রেরণ করি। ১০ জনের কাজ দুইজন দিয়ে করানো হলে ভালো সেবা দেওয়া সম্ভব না।”

রোগী ফজল শেখ, সেফালি বেগমসহ প্রায় সবাই অভিযোগ করেন, “হাসপাতালে ডাক্তার ও ঔষধ পাওয়া যায় না। আমরা বিনা পয়সায় চিকিৎসা ও ঔষধ কিছুই পাচ্ছি না।”
গর্ভবতী মা আমেনা বেগম ও নজির হোসেন করোনা পরীক্ষার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তারা ফিরে যান।

হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট অদিতী সাহা জানান, “আগে ৩৭ ধরনের ঔষধ সরবরাহ হতো। এখন মাত্র ১১ পদের ঔষধ সরবরাহ হচ্ছে। ফলে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী ঔষধ দেওয়া যাচ্ছে না।”

পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্থাপিত ৫০ শয্যার এই হাসপাতালটিতে ২৭ জন চিকিৎসকের পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র একজন।
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও মাঠ পর্যায়ের ২৫০টি পদে কর্মরত আছেন ১৭০ জন, এখনও ১০৭টি পদ শূন্য। একজন চিকিৎসক দিয়ে এত রোগী সামলানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঔষধ সরবরাহ সংকট ও জনবল সংকটে স্বাস্থ্যসেবা কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশেষ করে গাইনী, ডেন্টাল, সার্জারি ও অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক না থাকায় ডেলিভারি এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি ও ইসিজি মেশিন নষ্ট থাকায় সেবাও বন্ধ, কেবলমাত্র সম্প্রতি এক্স-রে চালু করা সম্ভব হয়েছে।

জানা যায়, এক বছর আগেও এখানে ১১ জন ডাক্তার ছিলেন। একে একে সবাই বদলি হয়ে চলে যান। বর্তমানে কেবল একজন মেডিকেল অফিসার, একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রয়েছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, “ডাক্তার ও জনবল সংকটে গাইনী এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতাল চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা দ্রুত করা হবে। ডাক্তার আনার জন্য আমরা, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন একসঙ্গে চেষ্টা করছি।”

উল্লেখ্য, গত এক বছর ধরে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে ঔষধ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকায় ক্লিনিকগুলো কার্যত বন্ধ। ফলে উপজেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু এখানেও ডাক্তার ও ঔষধ সংকটে স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অচল।

মিমিয়া

×