ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৫ জানুয়ারি ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

নতুন বছরে প্রবেশ করে ঢাকা কি তার নাগরিকদের জন্য নতুন কিছু উপহার দেয়ার পরিকল্পনা করছে? নাগরিকরা অবশ্য আশাবাদী, কেননা যুগল মেয়র নিয়ে ঢাকা শুরু করছে তার নতুন বছর। ঢাকা আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠুক। এটা অল্পসংখ্যক প্রধান কিছু চাওয়ার মধ্যে প্রথমদিকেই রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়রকে এক মন্ত্রী ও ক্রিকেট তারকসাহ ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামতে দেখা গেল প্রথম সপ্তাহেই। এটি নিছক ফটোসেশন হয়ে উঠবে না- এমনটাই প্রত্যাশা। যার কাজ তিনিই করবেন। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছেন, ঢাকার সড়ক পরিচ্ছন্ন রাখা তাদেরই কাজ। সবাই বোঝে গণমাধ্যমের ক্যামেরার একটা ভাল দৃশ্য হয় যদি গণ্যমান্যরা রাস্তার ওপর ঝাড়ু দেয়ার ভঙ্গি করেন। সমালোচনা নয়, বরং দাবিটাকে আরও দৃঢ় করার জন্য আমাদের এই শব্দচয়ন। মেয়র নিশ্চয়ই সিরিয়াস নগরীর নোংরা ময়লা-আবর্জনা দূর করার বিষয়ে। তবে এই কাজে নগরবাসীরও যে ভূমিকা আছে সেটাও বলতে হবে। না, পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নিতে বলছি না। সেটা করলে তো ভালই। বলতে চাইছি, শহর নোংরা না করলেই তো বড় কাজ করা হয়। আপনি যে সড়কেই থাকুন না কেন, কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক কাণ্ডকারখানাই চোখে পড়তে বাধ্য। শব্দ করে রাস্তার ওপর কফ-থুতু ফেলা এখন যেন নাগরিক অধিকারের ভেতরেই পড়ে! দৃশ্যটি যে কুৎসিত এবং কাজটি যে অভদ্রজনোচিত ও অস্বাস্থ্যকর সে কথা অনেকেই জানেন না। কিন্তু বিলক্ষণ মানবেন যে, এরাই আবার নিজের ঘরের মেঝেতে ওই কাজটি করেন না। আচ্ছা, পরের বাড়ি বেড়াতে গেলেও কি এই কাজ ঘরের মাঝখানে করা যাবে? যাবে না। তাঁরা করেনও না। তাহলে রাস্তার মাঝখানে কেন? তবে হ্যাঁ, রাস্তার মাঝখানে খোলা ডাস্টবিন দেখা যায়, সেখান থেকে আবর্জনা উপচে আশপাশে কয়েক গজ জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। এটা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তারাও যে দায়িত্বপরায়ণ নন, ‘রাস্তার লোকদের’ অভব্যতার বয়ানের পাশাপাশি সে কথাও আমাদের বার বার বলে যেতে হবে। আরেকটা কথা। শুধু আবর্জনা নয়, রাস্তার ধুলোও একটা মহাসমস্যা। ঢাকার প্রতিটি রাস্তা সর্বক্ষণ ধুলায় ধূসরিত হয়ে থাকে। এই ধুলার বিষয়টি অবশ্যই কর্মপরিকল্পনায় রাখতে হবে। রাস্তার ধুলা পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয় নাগরিকদের, পথচলার বিড়ম্বনা তো রয়েছেই। প্রাচীন ঢাকায় ভিস্তিওয়ালারা হররোজ নগরীর রাস্তায় রাস্তায় পানি ছিটাত। আধুনিক ঢাকায় ধুলা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। নগরবাসীর প্রত্যাশা, এবার মেয়রদ্বয় এদিকে দৃষ্টি দেবেন। থার্টিফার্স্টের বিকেলবেলা এবার থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপনের ব্যাপারে আগাম কিছু নির্দেশনা মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। ফলে ধারণা করা গিয়েছিল ঢাকার রাস্তায় অন্তত এবার খুব একটা হৈ-হুল্লোড় হবে না। আনন্দ-ফুর্তি যা হওয়ার তা ঘরোয়াভাবেই হবে। ঢাকার সব বার বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে। এমনকি ফোরস্টার-ফাইভস্টার হোটেলেও বিদেশী নাগরিক ছাড়া কারও কাছে এ্যালকোহল বিক্রি করার বিষয়েও নিষেধাজ্ঞা আসে। তাই সেদিন সকাল থেকেই বোঝা যায় মধ্যরাতে এবারকার ইংরেজী বর্ষবরণে ঢাকা মোটামুটি একটা অনাড়ম্বর অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। হয়েছেও তাই। সম্ভবত বিগত দুই দশকে কোন থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকা এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো। কথা হচ্ছে হার্ড ড্রিংকসের পসরা না হয় বন্ধ, সফট ড্রিংকে তো সমস্যা ছিল না। কিংবা কফিতে। ধানম-ির অভিজাত একটি কফিশপে (দোতলায়) যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে পা বাড়াতেই সিকিউরিটি জানালেন, কফিশপ বন্ধ! উল্টোদিকের মার্কেটের ভেতরের রেস্তরাঁয় ভাল কফি বানায়। সেখানে গিয়েও বিফল হতে হলো। সেটাও বন্ধ রাখা হয়েছে। এর কারণ কী হতে পারে? জানি না প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছিল কি-না। তরুণ-তরুণীরা যে রেস্তরাঁ ও কফিশপে গিয়ে আড্ডা জমিয়ে আনন্দ সন্ধ্যাটি উপভোগ করবে- তার সুযোগও এবার সীমিত ছিল। গাছ চেনা এবং বৃক্ষের জন্য এলিজি মানবজমিনে মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান করে বৃক্ষ। এই বৃক্ষসমাজের প্রতি আমাদের আচরণ কিরূপ? তাদের প্রতি আমরা কতটুকু কর্তব্য পালন করি? অথচ মানবজীবনের সুস্থতার স্বার্থেই বৃক্ষসম্পদের সুরক্ষা জরুরী। এই বিষয়টি আমরা বুঝেও বুঝি না। কথায় বলে, সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকা করে নিতে হয়। তুরস্কে ঠিক এই কাজটিই করেছে স্থানীয় পৌরসভা। সেখানে এখন বিয়ে করতে গেলে প্রয়োজন পড়বে বৃক্ষরোপণ সনদের! শুনতে অভিনব মনে হলেও এটাই বাস্তবতা। বছরের প্রথম দিন কার্জন হল প্রাঙ্গণে গাছ চেনানোর অনুষ্ঠান হলো। বৃক্ষপ্রেমী সংগঠন তরুপল্লব ২০০৮ সাল থেকে তাদের এ কার্যক্রম শুরু করেছে। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর রমনা পার্কে গাছ চেনানোর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তরুপল্লবের যাত্রা শুরু। তরুপল্লব এ পর্যন্ত গাছ চেনানোর ২০টি অনুষ্ঠান করেছে। উদ্যানকর্মীদের নিয়ে কর্মশালা, বৃক্ষরোপণ ও প্রকৃতিবিষয়ক সাময়িকী প্রকাশনাসহ নানামুখী সমাজ সচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তরুপল্লবের প্রায় সবকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন। পহেলা জানুয়ারি উপস্থিত প্রকৃতিপ্রেমীদের কার্জন হল প্রাঙ্গণ ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এই আয়োজনের তারিফ করতে হয়। ঢাকা শহরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী হয়ে থাকে মাঝেমধ্যে। আবার চুপিসারে বৃক্ষনিধনের মতো প্রকৃতিনাশকারী তৎপরতাও চলে। ঢাকার যে কটি এলাকার মানুষ এখনও বৃক্ষরাজির জন্য গর্ববোধ করে থাকে তার ভেতর রয়েছে ধানম-ি, সেগুনবাগিচা, বনানী ও উত্তরা। উত্তরার সবকটি সেক্টরেই রয়েছে যথেষ্ট পরিসর নিয়ে সুশোভন পার্ক। বেশিরভাগ পার্কেই পরিকল্পিতভাবে ফুলগাছ লাগানো এবং তার পরিচর্যা করা হয়। এই উত্তরার ললাটেই পড়ল এবার বৃক্ষনিধনের কলঙ্ক তিলক। উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের শাহজালাল এ্যাভিনিউ ও ৬ নম্বর সেক্টরের ঈশা খাঁ এ্যাভিনিউয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীনে সংস্কারকাজ চলছে। ওই দুই সড়ক থেকে ছোট-বড় মিলে প্রায় ২০০’র বেশি গাছ কাটা হয়েছে। দুই সড়কের পাশে মেহগনি, সেগুন, অর্জুন, আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারি, খেঁজুর, ইপিল ইপিল, শিশুসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিল। এগুলোর বয়স পাঁচ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। এলাকাবাসী মনে করেন, সড়ক সংস্কারের জন্য এত বিপুলসংখ্যক গাছ কাটা জরুরী ছিল না। সংস্কারের উছিলায় গাছ বিক্রি করার জন্যই গাছ কাটা হয়েছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক। নীরবে বৃক্ষহত্যা অনেকের জন্যই হৃদয়বিদারক। গাছ নিজে কথা বলে না, প্রতিবাদ করে না। নিষ্ঠুর মানুষ তারই সুযোগ গ্রহণ করে। হাতি মেরা সাথী হাতি মেরা সাথী নামে রাজেশ খান্নার একটা সিনেমা আছে যা খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ঢাকা শহরে হাতিকে সাথী করে জীবন কাটাচ্ছেন এমন মানুষ নিশ্চয়ই রয়েছেন। তা না হলে বছরের প্রথম দিনই সংসদ ভবন এলাকার পূর্বপাশে হঠাৎ জোড়া হাতির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাত হয়ে যাবে কেন? রাত ১০টার দিকে ওই দুটি হাতি প্রায় গলাগলি হয়ে রাতের ভোজনপর্ব সারছিল। বেশ কাহিল লাগছিল দুটিকে, ছিরিছাঁদ কিছুই অবশিষ্ট নেই। কুৎসিত বললেই যথার্থ বলা হবে। তবু হাতি বলে কথা। কথায় বলে- হাতি মরলেও লাখ টাকা। ঢাকা শহর এবং ঢাকার প্রান্তবর্তী এলাকায় (যেমন যাত্রাবাড়ীর ডেমরা রোডে) হাতিকে দিয়ে অভিনব একটি কাজ করানো হচ্ছে। চলন্ত গাড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়ছে হাতি। তারপর শুঁড় বাড়িয়ে দিচ্ছে চালক বা আরোহীর দিকে। এর অর্থ হচ্ছে- কিছু দাও। মনুষ্য সমাজের টাকাও দেখছি হাতি চেনে। টাকা সংগ্রহ করে শুঁড় উল্টে তার পিঠে থাকা মনিবের হাতে টাকাটা তুলে দিচ্ছে। কাজটি খানিকটা বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক। ব্যস্ত সড়কে এটা সম্ভবপর নয় সেটা হাতির ‘সাথী’ ভালই জানেন। তাই বেছে নেয়া হয় কিছুটা কম ব্যস্ততাপূর্ণ এলাকা, যাতে করে যানজট সৃষ্টি না হয় আর ট্রাফিক সার্জেন্টেরও ছুটে আসা না লাগে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নের স্বার্থে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন রয়েছে। রয়েছে তার বিধিমালা। হাতি পুষতে গেলে লাইসেন্স নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ নিয়ম প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। লাইসেন্স ফি ২০ হাজার টাকা। আর লাইসেন্স ফি প্রসেস করার জন্য দুই হাজার টাকা। এমনকি পজিশন ফি প্রতিটি হাতির জন্য গুনতে হয় চার হাজার টাকা। পাশাপাশি চারণ ফি হাতিপ্রতি এক হাজার টাকা। লাইসেন্স ফি পাওয়ার পর একজন হাতি লালন-পালনকারীকে কিংবা প্রতিষ্ঠানকে প্রতিটি হাতির জন্য পজিশন ফি জমা দিয়ে পজিশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। তবে এ ফি বছরে একবারই দিতে হয়। লাইসেন্সের মেয়াদ এক বছর, যা নবায়নের সুযোগ আছে। এসব আইনের কথা। ঢাকার হাতিওয়ালারা কি এসব মেনেটেনে চলেন? প্রিয় মেয়র, আপনাকেই বলছি আমরা এই কলামে ঢাকার দুই মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যার সমাধান ও অনিয়মের সুরাহা চাইছি। এটা নিছক আমাদের অনুরোধ নয়, সমাজেরই দাবি। নগরবাসীর খানিকটা আনন্দের জন্য, অবকাশযাপনের জন্য উদ্যান বা পার্কের তুলনা নেই। খোলা পরিবেশে অক্সিজেনসমৃদ্ধ খোলা বাতাসের ভেতর ঘুরে বেড়ানো, হাসি আর গানে মেতে ওঠার জায়গাগুলো ক্রমশ সঙ্কুচিত ও বেহাল হয়ে উঠেছে। ফার্মগেট ঢাকার অন্যতম একটি প্রাণকেন্দ্র। সেখানে একটি পার্ক রয়েছে। কিন্তু এর ভেতরে কিছুক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে। রীতিমতো ভাগাড়খানা হয়ে উঠেছে এই পার্ক। কোন রকম যতেœর ছাপ নেই। আমরা চাই রাজধানীর অন্তত এই একটি পার্ককে রাহুমুক্ত করা হোক নতুন বছরের শুরুতেই। প্রিয় মেয়র, ব্যবস্থা নিন। ৩ জানুয়ারি ২০১৬ [email protected]
×