ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২

গণভবন থেকে গুলি চালানোর আদেশ: আল জাজিরার ডকুমেন্টারিতে শেখ হাসিনার ভয়াবহতার প্রমাণ

প্রকাশিত: ১৬:২০, ২৫ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৬:২৫, ২৫ জুলাই ২০২৫

গণভবন থেকে গুলি চালানোর আদেশ: আল জাজিরার ডকুমেন্টারিতে শেখ হাসিনার ভয়াবহতার প্রমাণ

ছবিঃ সংগৃহীত

আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট (আই-ইউনিট) সম্প্রতি একটি বিস্ফোরক ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রকাশ করেছে যেখানে দাবি করা হয়েছে—২০২৫ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনার কথিত গোপন অডিও রেকর্ডিং শেখ হাসিনার নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা থেকেই ফাঁস হয়েছে।

একটি রেকর্ডিংয়ে হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, “আমি নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। এবার ওরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে, সেখানেই গুলি করবে।”
তাঁর কণ্ঠে যেন আর কোন দ্বিধা নেই—একটি উন্মুক্ত হত্যার আদেশ, যেটা অনেক এলাকায় ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করা হয় ভিডিওতে।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ডকুমেন্টারিতে বলেন, “এই অপারেশনকে ‘ক্লিন ডাউন’ বলা হয়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্রদের অবস্থান চিহ্নিত করে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”

ছবির মত একটি ভয়ংকর বর্ণনায় একজন ফটোজার্নালিস্ট পারভেজ আহমেদ রনি বলেন, “ওরা শিকারির মত আচরণ করছিল। বর্ডার গার্ডের একজন সদস্য এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন সে কোনো বন্য প্রাণী খুঁজছে, মেরে ফেলবে বলে।”

ডকুমেন্টারিতে হাসিনার গোয়েন্দা সংস্থার ভেতরের একাধিক কর্মকর্তা, প্রত্যক্ষদর্শী এবং আহতদের পরিবারের সদস্যরা মুখ খুলেছেন। তারা জানান, কীভাবে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী নিরীহ ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে।

একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমি বলেছিলাম, ম্যাডাম, রাস্তায় যারা আছে, তারা সবাই কিন্তু সাধারণ মানুষ। অনেকেই তো কোনো রাজনৈতিক কর্মীই না।”

তারা তুলে ধরেন ১২তম ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সায়েদের মৃত্যুর ঘটনা।
প্রত্যক্ষদর্শী ছাত্র সাংবাদিক তৌহিদুল হক সিয়াম বলেন, “একজন পুলিশ অফিসার খুব কাছে এসে তার বুকে তাক করে গুলি ছোড়ে।”
এই মৃত্যু যেন আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

আবু সাইদের সহযোদ্ধা আবু সাদিক কাইয়ুম বলেন, “ও যেভাবে দুই হাত ছড়িয়ে মারা গেল, আমরা শপথ করেছিলাম—আমরা সবাই সাইদ হয়ে উঠবো।”

কিন্তু ঘটনার পরে শুরু হয় সত্য গোপনের চেষ্টা।
আবু সায়েদের বোন জানান, “পুলিশ এমন একটি রিপোর্ট দিতে চেয়েছিল যেখানে বলা হবে, আমার ভাই পাথরের আঘাতে মারা গেছে।”
রংপুর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডা. রাজীবুল ইসলাম বলেন, “পুলিশ আমাকে মিথ্যা লিখতে চাপ দিচ্ছিল, কিন্তু আমি লিখিনি। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও রিপোর্ট পাল্টাতে চাপ এসেছিল।”

ডকুমেন্টারিতে উঠে আসে আন্দোলনে নিহত নাফিসার বাবার হৃদয়বিদারক সাক্ষাৎকারও।
আবুল হোসেন বলেন, “মেয়ে মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে বলল, আব্বু, আমি বাঁচবো না। আমার লাশ নিয়ে যেও। আমি মরতে যাচ্ছি।”

তবে সব কর্মকর্তা কিন্তু এই আদেশ মানেননি।
একজন সেনা কর্মকর্তা বলেন, “এই অস্ত্র, এই গুলি—সবই তো এই জনগণের টাকায় কেনা। তাহলে কেন আমরা এই অস্ত্র নিজের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছি?”

এদিকে শেখ হাসিনা এখনো অস্বীকার করে আসছেন যে তিনি কোনো হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।

ডকুমেন্টারির এক পর্যায়ে দেখা যায়, একটি মুহূর্তে সেনাপ্রধান হাসিনাকে বলেন,
“আপনার ৪০ মিনিট সময় আছে এলাকা ছাড়ার। না হলে জনগণ সব কিছু ধ্বংস করে দেবে।”
তখন হাসিনা চোখের জলে বলেন, “তাহলে আমাকে এখানেই মেরে ফেলুন। এই গণভবনের মাটিতে কবর দিন।”

আল জাজিরার এই অনুসন্ধান বলছে—এটা শুধু এক নেত্রীর পতনের গল্প নয়, বরং এটা এক নিপীড়িত জনগণের সাহসী প্রতিরোধের ইতিহাস। ছাত্র আন্দোলনের এই রক্তাক্ত অধ্যায় এখন কেবল একটি ভিডিও নয়—এটা হয়ে উঠেছে ইতিহাসের একটি সাক্ষী।

তথ্যসূত্রঃ https://www.facebook.com/share/v/19uVRCKwYd/

 
 

মারিয়া

×