ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

ছাত্রদের দেখার সাথেই গুলির নির্দেশ, আল জাজিরার তদন্তে শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী কাজের প্রমাণ মিললো

প্রকাশিত: ১৯:৪৬, ২৪ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ১৯:৫৪, ২৪ জুলাই ২০২৫

ছাত্রদের দেখার সাথেই গুলির নির্দেশ, আল জাজিরার তদন্তে শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী কাজের প্রমাণ মিললো

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালে ছাত্র আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন—এমন বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছে আল জাজিরার তদন্ত প্রতিবেদন। গোপনে রেকর্ড করা ফোনালাপ ও সেসবের ফরেনসিক বিশ্লেষণ থেকে উঠে এসেছে, শেখ হাসিনা বলেছিলেন:
"আমি ওপেন অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। এখন ওরা লেথাল উইপন (মারাত্মক অস্ত্র) ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে গুলি করুক।"

কী ঘটেছিল ২০২৪ সালে?
সবকিছু শুরু হয়েছিল এক আদালতের রায়ের মাধ্যমে, যেখানে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। এই ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। অনেক ছাত্রছাত্রী মনে করেন, এটি প্রকৃত মেধাবীদের ঠকায় এবং ক্ষমতাসীন দলের অনুগতদের বাড়তি সুবিধা দেয়।
এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জুন ২০২৪ থেকে সারাদেশে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।প্রথমদিকে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু ১৬ জুলাই এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে—রংপুরে ছাত্র নেতা আবু সায়েদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
এই মৃত্যুই হয়ে দাঁড়ায় আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক বাঁকবদল।

শেখ হাসিনার গোপন ফোনালাপ
আল জাজিরা জানায়, জাতীয় টেলিযোগাযোগ নজরদারি কেন্দ্র (NTMC) শেখ হাসিনার বেশ কিছু ফোনালাপ রেকর্ড করে। একটিতে তাঁকে স্পষ্টভাবে বলতে শোনা যায়—“আমি অনেকদিন ওদের থামিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু আর না। এখন যেভাবে দরকার, সেভাবেই ব্যবস্থা নিতে বলেছি।”
এমনকি ঢাকার দক্ষিণ মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে বলেন, হেলিকপ্টার থেকে নজরদারি এবং গুলি চালানো শুরু হয়েছে।

হাসপাতালের সামনে গুলিবর্ষণ?
পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাবির শরীফ জানালেন, আন্দোলনের সময় হেলিকপ্টার থেকে তাদের হাসপাতালের গেট লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়।
তিনি বলেন, “আমরা এমন অনেক শিক্ষার্থী পেয়েছিলাম, যাদের শরীরে বড় গুলির আঘাত ছিল—বুকে, কাঁধে—সব গুলিই শরীরের ভেতরে থেকে যাচ্ছিল। এক্স-রেতে এমন ভয়াবহ গুলি দেখে আমরা চমকে গিয়েছিলাম।”

ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাল্টাতে চাপ
আবু সায়েদের মৃত্যুর পর তাঁর ময়নাতদন্ত করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সেখানে দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ডা. রাজীবুল ইসলাম বলেন, “আমাদের উপর পাঁচবার রিপোর্ট পরিবর্তনের চাপ আসে। পুলিশ চাইছিল আমরা যেন লিখি সায়েদ মারা গেছে পাথর নিক্ষেপে আহত হয়ে। কিন্তু আমরা জানি সে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।”

লোক দেখানো সহানুভূতির আয়োজন
আবু সায়েদের মৃত্যুর ১২ দিন পর তাঁর পরিবারসহ ৪০ জন শহীদ পরিবারের সদস্যদের ঢাকায় গণভবনে ডেকে পাঠান শেখ হাসিনা।
টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে অর্থ বিতরণ করা হয়।
সায়েদের বোন সুমি খাতুন প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, “ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা গেছে পুলিশ গুলি করেছে। এখানে তদন্তের কী আছে? আমাদের এখানে আসাই ভুল ছিল।”

সায়েদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, “ওরা আমাদের জোর করে নিয়ে এসেছিল। না এলেই হয়তো অন্যভাবে নির্যাতন করতো।”

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) শেখ হাসিনা, তাঁর কয়েকজন মন্ত্রী এবং শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে।
শেখ হাসিনা এবং দুই মন্ত্রী ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত হন। বিচার শুরু হবে আগস্ট মাসে।
ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি তাজুল ইসলাম বলেন, “শেখ হাসিনা জানতেন ফোন রেকর্ড হচ্ছে। তবু তিনি বারবার বলতেন, ‘হ্যাঁ, আমি জানি, রেকর্ড হচ্ছে—কোনো সমস্যা নেই।’”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “অন্যদের জন্য যে গর্ত তিনি খুঁড়েছেন, এবার নিজেই সেই গর্তে পড়েছেন।”

আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, এই ফোনালাপ সম্পাদিত বা বিকৃত হতে পারে এবং শেখ হাসিনা কখনোই “লেথাল উইপন” ব্যবহার করতে বলেননি।
তারা আরও বলেছে, আবু সায়েদের মৃত্যুর তদন্ত ছিল “গভীর ও আন্তরিক”।

এই প্রতিবেদন শুধু একটি ঘটনার বর্ণনা নয়—এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন, দমন-পীড়ন এবং ক্ষমতার দাম্ভিকতার এক নির্মম চিত্র।
অনেকের জন্য এটি শেখ হাসিনার শাসনের অন্ধকার অধ্যায়, আবার অনেকের কাছে এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ।
 

তথ্যসূত্রঃ https://www.facebook.com/share/16wjZi5tLX/

 
 
 
 

মারিয়া

×