ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২

চাকরি রক্ষায় মরিয়া আন্দোলনকারীরা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:৩৩, ৮ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০০:৪১, ৮ জুলাই ২০২৫

চাকরি রক্ষায় মরিয়া আন্দোলনকারীরা

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রাণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি দিয়ে ‘রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ’ করেছেন বলে এখন অকপটে স্বীকার করছেন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশেষ করে বড় বড় কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পাশাপাশি দুই ডজনের বেশি কর্মকর্তার অপরাধ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক তদন্তাধীন থাকায় সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক।

বরখাস্ত, অবসর, তদন্তের তালিকা থেকে নাম কাটাতে জনে জনে তদবির করছেন এবং চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন তারা। দুদক কর্তৃক তদন্তের চেয়ে বরখাস্ত হওয়াকে নিজের জন্য সুবিধাজনক মনে করে তদবির করছেন অধিকাংশ কর্মকর্তা। তাদের ধারণা, বরখাস্ত হলে মামলা করে চাকরি ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু দুদক তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে!
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, দেড় মাসব্যাপী আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে জড়িতদের একাধিক তালিকা তৈরি করেছে সরকার। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এ জন্য রাত-দিন কাজ করছে। বড় ধরনের শাস্তির তালিকায় রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক নাম। যদিও আন্দোলন প্রত্যাহারের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংশ্লিষ্টতার কোনো অভিযোগ আনা হচ্ছে না। এনবিআরের দুই সদস্যসহ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। 
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেন, হোসেন আহমদ ও আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদকে। আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতার কোনো অভিযোগ না এনে জনস্বার্থে তাদের সরকারি চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হয়েছে বলে জানায় সরকার। অন্যদিকে কাজ বন্ধ রাখার দায়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জানা গেছে, তিনিও আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিতে অংশ নেন।
দূদকের তদন্তাধীন থাকা কর্মকর্তা হলেন বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামারুজ্জামান, ঢাকা পূর্ব কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, আয়কর বিভাগের অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা, উপ-কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ, অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, সদস্য লুতফুল আজীম, সিআইসির সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, উপ কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম, যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান।

এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম, অতিরিক্ত কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান তারেক রিকাবদার ও অতিরিক্ত কমিশনার ও সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য সাধন কুমার কুন্ডু। 
এদের মধ্যে পাঁচজনই এনবিআরের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন। বাকিরাও নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন এ আন্দোলনে। অভিযুক্তরা এনবিআর সংস্কারের বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আন্দোলনকারীদের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ সোচ্চার ছিলেন।
রাজস্ব খাতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে দেড় মাস ধরে আন্দোলন করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। শেষ পর্যায়ে এসে দুই দিন কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে সারাদেশের রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অচল হয়ে যায়। অবশেষে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় গত রবিবার রাতে আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভয়ডরহীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানান। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অর্থ উপদেষ্টা তার কথা রাখেননি। আন্দোলনকারীদের হয়রানি করা হচ্ছে। দুদক দিয়ে তদন্ত করানো হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠানো হচ্ছে। গণহারে বদলি করা হচ্ছে। 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ এক নেতা বলেন, আন্দোলন প্রত্যাহারের পর কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বাধ্যতামূলক অবসর, বরখাস্ত, বদলি, সবই চলছে। সব শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ছাড়া এনবিআরের সংকট নিরসনে সরকার গঠিত পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিতেও আন্দোলনকারীদের এখনো ডাকা হয়নি।
যদিও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান দায় এড়িয়ে বলেছেন, এগুলো সরকারের রূটিন কাজ। সরকার আইনের মধ্যে থেকেই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আর দুদক যা করছে সেটি তাদের নৈমিত্তিক কাজ। আন্দোলনকারীদের নয়, দুদক তদন্ত করছে দুর্নীতির অভিযেগে অভিযুক্তদের ফাইল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব সরকারের নীতি সিদ্ধান্ত। সেখানে আমি কিছু বলতে পারি না।

যদিও সোমবার এক অনুষ্ঠানে শেষে এনবিআর চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করতে চাই, যদি প্রত্যেকে দায়িত্বশীল আচরণ করেন এবং সুষ্ঠুভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন, তা হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে কেউ কেউ অবশ্য বড় ধরনের সীমা লঙ্ঘন করেছেন। এই বিষয়গুলো হয়তো আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হবে। তবে সামগ্রিকভাবে আমার মনে হয় না কারও আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন আছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কর ও শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকর্তার কারণে প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেÑ এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
এদিকে মাত্র ক’দিন আগেও যারা সরকারের উপদেষ্টা এবং এনবিআর চেয়ারম্যানকে থোড়াই কেয়ার করেছেন, জোরালো কণ্ঠে হুংকার ছেড়েছেন, নিজেদের দাবি আদায়ে দর কষাকষি করেছেন তারা এখন দিন কাটাচ্ছেন বহিষ্কার আর দুদক আতঙ্কে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তাদের বোধোদয় হয়েছেÑ আন্দোলন করা ভুল ছিল। চাকরি বাঁচাতে এরই মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন অনেকে। কেউ আবার যোগাযোগ করছেন চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে।

অধিকাংশ কর্মকর্তাই আন্দোলনকে ভুল আখ্যা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেশিরভাগ কর্মকর্তা গণমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। কেউ কেউ ফোন বন্ধ রেখেছেন। এনবিআর কর্মকর্তাদের নিজস্ব গ্রুপ ও আন্দোলনের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে লিভ নিয়েছেন অনেকেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিকাংশ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে আন্দোলন করা ভুল ছিল। অর্থনীতির ব্লাড লাইন পোর্ট অচল করাও সঠিক হয়নি। তারা এখন পরিবারের সদস্য এবং আশপাশের লোকদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন, চাকরি গেলে বা দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে তারা যাতে বিচলিত না হয়। অনেকে আবার চাকরি হারানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন। তদবির করছেন তালিকা থেকে নাম কাটানোর। একজনের মন্তব্য ‘আমি আন্দোলনে ছিলাম না। আন্দোলনের গ্রুপে আমাকে কেউ যুক্ত করেছে। এখন খুবই টেনশন হচ্ছে।’
এদিকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে সরকার উভয় সংকট আছে মন্তব্য করে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হতো, তা হলে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি হতো যে শৃঙ্খলাভঙ্গ করেও পার পাওয়া যায়। আবার যেহেতু একটি সমঝোতা হয়েছিল, তাই এত দ্রুত এ ধরনের শাস্তি না দিয়ে একটু রয়ে-সয়ে করা যেত। তা হলে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এখন যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।
সংস্কারের অংশ হিসেবে গত ১২ মে মধ্যরাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে দৃথক দুটি বিভাগ সৃষ্টির অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এর বিরুদ্ধে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মসূচির ফলে সরকার গত ২৫ মে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্ত না করার বিষয় জানায়। বরং এটিকে সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগের মর্যাদায় আরও শক্তিশালী করা, রাজস্ব নীতি প্রণয়ণের লক্ষ্যে আলাদা একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠন এবং প্রয়োজনীয় সব সংশোধনের আগ পর্যন্ত জারি করা অধ্যাদেশ কার্যকর করা হবে না বলে জানানো হয়। 
তার পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্য পরিষদ তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর কাজে যোগ দিলেও আন্দোলনকারীরা এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে অটল থাকেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় অফিসে ফেরেন এনবিআর চেয়ারম্যান। ২৯ জুন রাজস্ব সংস্কারে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।

প্যানেল হু

×