
ছবিঃ প্রতিবেদক
দক্ষিনাঞ্চলের বাগেরহাট জেলা থেকে উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরে এসেছিলেন মৌ-খামারি আরিফুল ইসলাম। তিনি জানালেন, ‘চলতি মৌসুমে এবার লিচু ফুলের শেষ সময়ে ১৪ দিনে ১০০টি মৌবক্স স্থাপন করেছিলাম। বড়ই হতাশার মধ্যে ছিলাম। আশা যাওয়ার খরচ উঠবে কিনা এই চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু যেটা স্বপ্নেও ভাবিনি সেটা পেয়ে নিজেই অবাক না হয়ে পারিনি।’
তিনি বললেন, ‘মাত্র ১৪ দিনে ১ টন মধু উৎপাদন করেছি। যা রীতিমতো রেকর্ড। ৩০০ টাকা কেজি হিসেবে মধু বিক্রি করে পেয়েছি ৩ লাখ টাকা। আসা-যাওয়া এবং খাওয়া বাবদ সর্বোচ্চ খরচ হয় ৫০ হাজার টাকা। মাত্র ১৪ দিনে আয় করেছি আড়াই লাখ টাকা।’
লিচুর রাজ্য খ্যাত দিনাজপুরে লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহের বিপ্লব ঘটেছে এবার। রেকর্ড পরিমাণ মধু সংগ্রহ করেছে মৌ-চাষিরা। মৌসুমের শেষে ফিরে যাওয়ার সময় এমনই বর্ণনা দিয়েছেন স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা খামারিরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, দিনাজপুরের লিচুর যেমন সারাদেশে কদর আছে; তেমনই লিচুর ফুল থেকে সংগ্রহ করা মধুরও ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। দিনাজপুরের ১৩ উপজেলার লিচুর বাগান রয়েছে। তবে লিচুর বেশি বাগান রয়েছে দিনাজপুর সদর, চিরিরবন্দর, খানসামা ও বীরগঞ্জ উপজেলায়।
সাতক্ষীরা থেকে মৌ চাষি মো. মিলন ও সিরাজগঞ্জের মৌ চাষি শহিদুল ইসলাম জানান, ‘দিনাজপুরে এ বছর গাছে গাছে লিচু মুকুলের সংখ্যা ছিল অনেক। তাই মধু পাওয়া যায় অনেক বেশি। বিসিকের দিনাজপুরের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘লিচু থেকে আহরণকৃত মধুর চাহিদা সারা দেশেই রয়েছে। তাই এ ধরনের মধু ব্যবসা লাভজনক। এবার বিসিকের পক্ষ থেকে ১৫০ মৌ চাষিকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যেককে একটি করে মৌ বাক্স দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৬ হাজার হেক্টর জমির অসংখ্য লিচুর গাছে এবার মধু উৎপাদন বলতে গেলে রেকর্ড পরিমাণ হয়েছে। আর এ কাজে বিসিকের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা বাগান মালিক ও মৌ চাষিদের কারিগরিসহ সব ধরনের পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করছেন।’
মার্চের শুরু থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত প্রতিটি গাছে মুকুলে ভরে যায়। এ সময় মধু আহরণের লক্ষ্যে মৌ-খামারিরা লিচু বাগানে শত শত মৌ-বাক্স স্থাপন করেন। দিনাজপুরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও মৌ খামারিরা এখানে আসেন। মুকুল থাকাকালে মৌ-খামারিরা মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন।
মৌ খামারি রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘সারা বছর আমরা লিচুর মুকুল থেকে মধু আহরণের অপেক্ষায় থাকি। এবার মার্চের শুরুতেই ৪৫০ বাক্স স্থাপন করেছিলাম। মাসে ২০০ মণ মধু আহরণ করতে পেরেছি। প্রতি বাক্স থেকে ছয়-সাত কেজি মধু সংগ্রহ হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের খামারে পাঁচ-সাতজন শ্রমিক কাজ করে। আমরা ছয়-সাত দিন পর মধু হারভেস্ট করি।’
লিচু বাগানি মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার ১ একর জমিতে লিচু বাগান। মৌ খামারিরা মৌ-বাক্স স্থাপন করায় ৩০-৩৫ শতাংশ ফলন বৃদ্ধি পায়। আলাদা পাহারাদারের প্রয়োজন পড়েনি।’ এদিকে মাসিমপুরের লিচু বাগানি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘মৌ-বাক্স স্থাপন করায় মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ণ হয়। ফলে লিচুর আকৃতি, মিষ্টতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। স্প্রের প্রয়োজন কম হয়, খরচও কমে যায়।’
সরকারি হিসাবে, ২০১৫ সালে দিনাজপুরে লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছিল ২৩ হাজার ৩৬০ কেজি। ২০২৪ সালে ১০ বছরের ব্যবধানে ১৬৭ জন খামারি ৯ হাজার ১৮২টি মৌ-বক্স স্থাপন করে ৬৭ মেট্রিক টন মধু উৎপাদন করেন। সরকারি হিসাবে ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত কেজি হিসেবে যার বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এবার সরকারি তথ্য সংগ্রহ চলমান। তবে প্রাথমিকভাবে তারা জানিয়েছেন, এবার দিনাজপুরে ৩৩৫ জন খামারি ১২ হাজার মৌ-বক্স স্থান করেছিল।
সরকারি পরিসংখ্যানের পাশাপাশি মৌ-চাষিদের সংগঠন উত্তরবঙ্গ হানি কমিউনিটির পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার জন্য চলতি মৌসুমে প্রায় দেড় হাজার মৌখামারি প্রায় সোয়া লাখ মৌবক্স স্থাপন করেছিলেন। প্রত্যেক খামারি গড়ে প্রায় ৩ টন করে মধু সংগ্রহ করেছেন। যা ৩০০ টাকা কেজি হিসেবে বর্তমান বাজার মূল্য ১২০ কোটি।’
মৌচাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যেকে কমপক্ষে ১০০টি মৌ-বক্স নিয়ে আসেন। ১০০ মৌ-বক্স আছে এমন একজন চাষি কমপক্ষে ৩ হাজার কেজি মধু সংগ্রহ করেন।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৫ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান হয়েছে। গত বছর মধু সংগ্রহের জন্য ৪ হাজার ৯৫৪টি বক্স স্থাপন করা হয়েছিল। উত্তরবঙ্গ হানি কমিউনিটির নির্বাহী সদস্য ও এমবিএফের মালিক মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘জেলায় প্রায় দেড় হাজার মৌচাষি মৌ-বক্স স্থাপন করেছেন। এবার প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। দিনাজপুরে মধু উৎপাদন জনপ্রিয়তা লাভ করছে। যা বাগেরহাট থেকে আসা মৌ খামারি আরিফুল ইসলাম মাত্র ১৪ দিনে ১ টন মধু আহরণ করে বাজিমাত করে দিয়েছেন।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. আনিছুজ্জামান বলেন, ‘মৌমাছি দিয়ে পরাগায়ণ হলে গাছে ২০ ভাগ লিচু বেশি উৎপাদন হয়। বর্তমানে লিচুর ফুল থেকে সবচেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ হচ্ছে। লিচুর ফুলের মধু জমাট বাঁধে না। বিসিক ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর অনেক যুবককে প্রশিণ দিয়েছে। স্থানীয়দের আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে পারলে উৎপাদন বাড়বে, বিপুল আয় হবে।’
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক জাফর ইকবাল বলেন, ‘দিনাজপুর লিচুর জেলা। পরাগায়ণের জন্য মৌ-বাক্স স্থাপন অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে লিচুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং বিপুল পরিমাণ মধু আহরণ সম্ভব হয়। এতে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মৌ-বাক্স স্থাপন দুপক্ষের জন্যই লাভজনক।’
আরশি