
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী দুই মাসের মধ্যে কৃষিজমি সুরক্ষা আইন পাস করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যেই কৃষিজমি সুরক্ষা আইন পাস করতে পারব। সেখানে কৃষকের সুরক্ষার কথাও থাকবে। কৃষক সুরক্ষায়ও স্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
সোমবার রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ‘কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাণ-প্রকৃতি সম্মেলন-২০২৫’র দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি এ কথা বলেন। দ্বিতীয় অধিবেশনের শিরোনাম ছিল ‘কৃষি উৎপাদন ও প্রাণ-প্রকৃতি’।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে পরিবেশ, জনগণ ও কৃষির নিরাপত্তা দেওয়া। আবার উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। আমাদের এসব ‘যদি কিন্তু’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটি শুধু রাষ্ট্রের দায় নয়, ব্যক্তি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের টেবিলে শুধু অনেক পরিমাণে খাদ্য পৌঁছালেই হবে না, সেটার মান নিয়েও ভাবতে হবে। ঢাকা শহরের মানুষকে পানি খাওয়ার জন্য মেঘনা নদীতে যেতে হচ্ছে। ওখানে আবার বালু ও সিমেন্ট কারখানা থাকায় আলাদা করে টাস্কফোর্স করতে হচ্ছে। আমাদের এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, এক ফসলি জমি নিয়ে অনেক কথা হয়। বাস্তবে এক ফসলি জমি খুবই কম। বেশিরভাগ জমি দুই-তিন ফসলি। আধুনিক কৃষির নামে অনেককিছু এ দেশে নিয়ে আসা হচ্ছে, যা অন্য দেশগুলোতে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কৃষিজমি কিংবা কৃষকের স্বার্থকে বাদ দিয়ে কৃষির কথা বলা যাবে না। আরও বেশি উৎপাদন ও মুনাফার লোভে অপরীক্ষিত কিছু যেন আমরা ব্যবহার না করি।
চলতি মাসেই টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবনে ১৫০ একর জমিতে ইউক্যালিপটাস বাদ দিয়ে শাল গাছ লাগানো শুরু হবে বলে জানান উপদেষ্টা।
কৃষকের স্বার্থও দেখতে হবে : ফরিদা আখতার ॥ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, খাদ্য নিরাপত্তায় জোর দিতে গিয়ে কৃষকের দিকটা সেভাবে দেখা হয় না। শহুরে মানুষের খাদ্য জোগান এবং দাম নাগালে রাখতে আমদানির মাধ্যমে কৃষকের ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়। তিনি বলেন, খাদ্যে আমাদের সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে হবে, যাতে ভোক্তা এবং কৃষক দুই পক্ষই উপকৃত হন। তাই ভোক্তার খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থ দেখতে হবে।
‘কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা সম্মেলন ২০২৫’ শীর্ষক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষকের ন্যায্যতা’ অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের কথা বলা হচ্ছে। সেটা করতে গিয়ে কোনোও ক্ষতি করছি কিনা সেটিও দেখতে হবে। কারণ, এর কারণে গবাদিপশুর ব্যবহার কমে যাচ্ছে।
এখানে ভোক্তার দিকটাও দেখতে হবে, যেন তারা নিরাপদ খাদ্য পায়। আবার কৃষকের দিকটাও দেখতে হবে, যেন তারা উৎপাদন করে লাভবান হন। খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে যদি প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে ফেলি তাহলে আবার সেটি খাদ্যপণ্য হবে কি? সেটা শিল্প পণ্য হয়ে যাবে। যদি কৃষি পণ্যকে শিল্প পণ্যের মতো উৎপাদন করি, তাহলে সেটি খাদ্য থাকবে না এবং সেখানে কৃষকও থাকবে না।
উপদেষ্টা বলেন, এক সময় কৃষির অধীনেই মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ছিল। এখন এগুলো আলাদা হয়েছে। পণ্যভিত্তিক কৃষকও আলাদা হয়েছে। মৎস্যের ক্ষেত্রে আমরা যদি দেখি, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশ ভারতের পরইÑ দ্বিতীয় স্থানে আছে। অথচ হাওর, নদী-নালা ধ্বংস করছি আমরা। জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে চাচ্ছি যখন তখন আবার দেখা যাচ্ছে কৃষিতে ব্যবহৃত কীটনাশকে মাছ মারা যাচ্ছে।
হাওরে কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাওর মাছের অনেক বড় একটি উৎস। আবার অনেক সময় আগাছা পরিষ্কার না করে কীটনাশক দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা হয়। এতে করে গরু-ছাগলসহ অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি হচ্ছে। এমন ঘটনাও আমরা দেখেছি, জমির বাঁধা কপি খেয়ে ছাগল মরে গেছে। কারণ সেখানে কীটনাশক ছিল। সেই বাঁধা কপি কিন্তু মানুষও খাচ্ছে। ফলে এখানে একটা নীতি গ্রহণ করা দরকার। এসব বিষয়ে কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের এখানে মাংস উৎপাদন চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। আগস্টের বন্যার কারণে ডিমের দাম যখন বেড়ে গিয়েছিল, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম আমদানি করে। তখন এখানে যারা উৎপাদক তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা থেকে মাংস আমদানির জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। তারা কম দামে মাংস দেবে। এখন আমাদের তো লাখ লাখ খামারি আছে।
আমাদের এখানে এক কোটি ২৪ লাখের বেশি গরু-ছাগল মজুত আছে। ২২ লাখের মতো চাহিদার চেয়ে বেশি আছে। এটি করলে এখানে খামারিরা টিকে থাকতে পারবে না।
সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সম্মানিত অতিথি হিসেবে ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। এছাড়া এতে প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নেন মাল্টিমোড গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী, আইইউবিএটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রব, বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি খুশী কবীর ও গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তোফাজ্জল ইসলাম।
আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, দেশে কৃষিজমি দিন দিন কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে একই জমিতে বারবার চাষ করার প্রযুক্তি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, নগরায়ন ও শিল্পায়ন বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে কৃষিজমির ওপর। একই সঙ্গে বাড়ছে দেশের জনসংখ্যা। মানুষের জীবনমান উন্নত হওয়ার সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন হচ্ছে।
সে অনুযায়ী কোন খাদ্য কতটুকু উৎপাদন করতে হবে তা নির্ধারণ করাও জরুরি। তিনি আরও বলেন, মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা প্রয়োজন। কৃষি ও প্রাণ-প্রকৃতি একে অন্যের সঙ্গে জড়িত ও পরিপূরক। তাই খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ও প্রকৃতি রক্ষায় উভয় দিকেই গুরুত্ব দিতে হবে।