
কৃষি উৎপাদন
কৃষি বাজেট নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সার্বিকভাবে কৃষিকে মূল্যায়ন করে এই খাতে বাজেটের আকার বাড়ান না। দেশে বর্তমানে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রয়েছে তার মূল কারণ কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া। তাই মূল্যস্ফীতি কমাতে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কৃষি বাজেট ২০২৫-২৬ : টেকসই প্রবৃদ্ধির রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারা এমনটা বলেন। বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির (বিএইএ) উদ্যোগে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। বিএইএ সভাপতি মো. আহসানুজ্জামান লিন্টুর সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে সবাই চিন্তিত। এর মূলে রয়েছে কৃষির উৎপাদন কমে যাওয়া। দেশে প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কৃষি জমি কমছে। তার বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, ভূরাজনীতি ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তাই স্থানীয়ভাবে কৃষি কাজ ও খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো দরকার।
এ জন্য আসছে বাজেটে কৃষি খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ হারে বাজেট বাড়লেও কৃষি বাজেট বাড়ছে ৩ শতাংশ হারে। মোট বাজেটের মধ্যে ১০ শতাংশ হারে কৃষি ও ৫ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিতে হবে।
সভায় অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদরা কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার ও বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে বলেন, স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। অপরদিকে উৎপাদন ব্যয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। এতে কৃষকের আয় বাড়বে ৩০-৪০ শতাংশের বেশি। এ জন্য কৃষি বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
এ সময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষি বাজেট যারা প্রণয়ন করেন তারা কৃষির সার্বিক মূল্যায়ন করে বাজেট বাড়ান না। আমরা খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে চিন্তিত। অথচ এর মূলে রয়েছে কৃষির উৎপাদন হ্রাস পাওয়া। মূল্যস্ফীতি কমাতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কৃষি খাতে পণ্যের যথাযথ মূল্য নিশ্চিতে কাজ করতে হবে জানিয়ে এই খাতে প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিতে বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সভায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে কৃষিতে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। এ সময় পোল্ট্রি ফিড তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট-শুল্ক কমানোর পাশাপাশি খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা দেওয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আনিস্জ্জুামান চৌধুরী বলেন, কৃষিতে গবেষণা বাড়ছে। এখাতে অভূত উন্নতি হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতার মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টস, রেমিটেন্স ও কৃষি অর্থনীতি। ‘তিনটি সেক্টর বাংলাদেশের রূপান্তরে ভূমিকা রাখছে। সেগুলো হলো-গার্মেন্টস, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও কৃষি। তিনটির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হচ্ছে কৃষি সেক্টর। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিকে উপেক্ষা করতে পারব না। অনেকে বলছেন, কৃষির গ্রোথ (বিকাশ) কম। গ্রোথ বাড়ানো যাবে। তবে আমাদের কোয়ালিটি গ্রোথ বাড়াতে হবে।’
আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউ থেকে বের করে এনেছি। রুগ্ন দশা কেটে গেছে। ভয় পাবেন না, আমরা আছি। বাংলাদেশকে ভর্তুকি থেকে আস্তে আস্তে বের হতে হবে, গবেষণা ও উন্নয়নের অর্থ বেশি খরচ করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
কৃষিকে জাতীয় অর্থনীতির ‘মেরুদ-’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষির উন্নয়ন ছাড়া উন্নত দেশ হওয়া যাবে না। খাদ্যমূল্য স্থিতিশীল ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষির আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকের অবস্থা জানতে হবে। কৃষিতে নারী কর্মীর মূল্যয়ন করতে হবে। কৃষি হচ্ছে আমাদের মেরুদ-, কৃষির উন্নয়নে আমাদের কাজ করতে হবে।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, দেশে প্রতি বছর ১ দশমিক ২ শতাংশ প্রাকৃতিক জলাশয় দখল ও দূষণে হারাচ্ছে। অথচ ভিয়েতনাম ও চীনে সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসব সংরক্ষণ করা হচ্ছে। তাই দেশেও জলাশয়কে রিজার্ভ হিসেব চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করতে হবে।
ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরে বছরে ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যায়। এটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ মাত্র শূন্য দশমিক ৭ মিলিয়ন টন আহরণ করা হয়।
তিনি বলেন, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে কৃষকরাই সরাসরি উপকৃত হন। তাই কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের উন্নয়ন করতে হবে আমাদের। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে ফসল সংগ্রহের পর ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়। এই ক্ষতি কমাতে উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়া প্রয়োজন। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ প্রয়োজন।
পণ্য সংরক্ষণে সরকারের বাজেট সহায়তা দেওয়ার কথা তুলে ধরে মিজানুর রহমান বলেন, সংরক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। জেলা ও উপজেলায় আধুনিক হিমাগার নির্মাণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেল প্রবর্তন করে কাজ করতে হবে। কৃষক থেকে বাজার পর্যন্ত পণ্য পরবহনের ট্যাকিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
টমেটো, পেঁয়াজ, আম, লিচু ইত্যাদি পচনশীল মৌসুমি ফল ও সবজির নষ্ট হওয়া ঠেকাতে- ব্লাস্ট ফ্রিজিং সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় ভাজা মাছ, শুকনা শাক-সবজি, ফলের জুশ ও দুগ্ধজাত পণ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ প্রক্রিয়াজাত অঞ্চল গঠনের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি আরও বলেন, কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে ড. মিজানুর রহমান বলেন, ভিয়েতনামে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ২০ শতাংশ সরকারি ভর্তুকি রয়েছে, যার ফলে রপ্তানি গত এক দশকে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে তাদের। প্রসঙ্গত, কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা সুবিধা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও একসময় এই হার ২০ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সভাপতি মো. আহসানুজ্জামান লিন্টু বলেন, কৃষকের ছেলেরা কিন্তু এখন কৃষি কাজ করতে চাচ্ছে না। তাই কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে দ্রুত। যখন ফসল তোলার মৌসুম হয়, তখন শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। কৃষি পণ্যের দাম কৃষকের কাছ থেকে সরে গেলেই বেড়ে যায়, তাই কৃষক যেন পণ্য সংরক্ষণ করতে পারে সে জন্য সরকারকেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার টাকা লুট হয়েছে অথচ কৃষক সহজে ঋণ পাচ্ছে না। কৃষক যেন সহজে ঋণ পায় সে ব্যবস্থাটা থাকতে হবে। কৃষক যখন ফসল তুলবে, তখনও যেন ঋণ নিতে পারে সেটাও চালু করা উচিত; কারণ টাকা না থাকায় তখন কম দামে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য হন কৃষক। এ ঋণ দেওয়া হলে কৃষকের জন্য তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সহায়ক হবে।