
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ বর্তমানে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রয়েছে, সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। যদিও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ স্মৃতি এখনও গভীরভাবে গেঁথে আছে, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যে পুরনো তিক্ততা ভুলে যেতে বাধ্য করছে।
সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ছে
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সামরিক যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিছুদিন আগেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানের নেতৃত্বে একটি বাংলাদেশি সামরিক প্রতিনিধিদল রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। এর পরপরই পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (ISI) এর উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছে।
এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যগতভাবে সতর্ক পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় পরিবর্তন।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এড়িয়ে এসেছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের জন্য পাকিস্তান এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। এই অপমানজনক ইতিহাস ভুলে যাওয়া সহজ নয়।
১৯৭১-এর স্মৃতি ভুলে যাওয়ার ঝুঁকি
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল আত্মপরিচয়, ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিচালনা করে, যেখানে হাজার হাজার বাঙালি নাগরিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা হয়। চুকনগর গণহত্যায় প্রায় ১০,০০০ শরণার্থীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা সেই সময়ের নিষ্ঠুরতার প্রতিচিত্র।
লেখক কে.এস. নায়ার তার বই December in Dacca-তে লিখেছেন,
"১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতার কারণে ১ কোটি বাঙালি শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি।"
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না, এটি ছিল স্বাধিকারের জন্য এক কঠোর সংগ্রাম, যেখানে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা হয়েছিল। তাই ১৯৭১-এর ইতিহাস মনে রাখা শুধু গর্বের বিষয় নয়, এটি জাতিগত অস্তিত্ব রক্ষার শপথও।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও পাকিস্তানের প্রভাব
স্বাধীনতার সময় ভারত ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মিত্র। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের একসঙ্গে লড়াইয়ের ফলেই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু কূটনৈতিক টানাপোড়েন দেখা গেলেও, ইতিহাস সাক্ষী যে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে অমূল্য বন্ধুরূপে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা অনেকের কাছেই ১৯৭১-এর চেতনার অবমাননা বলে মনে হচ্ছে।
কূটনীতির ভবিষ্যৎ
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আগে ১৯৭১ সালের বিভীষিকা নিয়ে একটি স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই ভবিষ্যতের পথচলা ঠিক করতে হবে।
যদি ১৯৭১-এর গণহত্যার জন্য পাকিস্তান এখনো ক্ষমা না চায়, তবে বাংলাদেশের জন্য এটি শুধুই কূটনৈতিক কৌশল নয়, বরং জাতিগত মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানের প্রশ্ন।
কারণ একটাই—"জাতি তার ইতিহাস ভুললে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে।"
©অরিত্র ব্যানার্জী
মারিয়া