ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১২ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১

নিরাপত্তায় লাখো আইনশৃঙ্খলাবাহিনী

মন্দিরে মন্দিরে প্রতিমার গায়ে তুলির শেষ আঁচর

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ৭ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১০:০১, ৭ অক্টোবর ২০২৪

মন্দিরে মন্দিরে প্রতিমার গায়ে তুলির শেষ আঁচর

বাজছে বাদ্য, আসছে দেবী। ছবি: সংগৃহীত

  • উৎসবের আমেজে পুরো দেশ

আকাশে বৃষ্টির ঘনঘটা থাকলেও প্রকৃতিতে হেসেছে শরতের কাঁশফুল। মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে হেসে উঠছে দ্বাদশীর চাঁদও। এখানে-সেখানে কাঁশফুলের শুভ্রতা নাড়া দিচ্ছে কবি মনে। এমন পরিবেশ যেনো পুরো বাঙালির জন্য একরাশ নষ্টালজিয়া। শরতের বাতাস মানেই দুর্গাপূজার গন্ধমাখানো। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও দেশজুড়ে সব ধর্মাবলম্বীর মাঝে তৈরি হয় উৎসবের উন্মোদনা।

আর সেই উন্মাদনায় মাততে প্রস্তুত পুরো দেশ। দেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি ম্যাপে চলছে প্রতিমার গায়ে তুলির শেষ আঁচর দেয়ার কাজ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিয়মিত  ম্যাপের অনেকগুলোতে এবার পূজা না হলেও নতুন করে বাড়তি  ম্যাপ সাজছে নানান জায়গায়। আর নিরাপত্তায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রস্তুত করা হয়েছে লাখের বেশি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে। রাজধানীসহ দেশের সব শপিংমলগুলোতেও জমে উঠেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজার শেষ মুহুর্তের কেনাকাটা। 

নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, দুর্গাপূজা উৎসবকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে চলছে ব্যাপক সাজসজ্জা। প্রতিটি মণ্ডপের জন্য তৈরি হচ্ছে দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী , কার্তিক, অসুর, সিংহ, হাঁস, পেঁচাসহ বিভিন্ন প্রতিমা। অধিকাংশ মণ্ডপের কারিগররাই ইতিমধ্যে শেষ করেছেন প্রতিমার অবয়ব তৈরির কাজ। এখন চলছে রং করার কাজ। বুধবার মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে শুরু হবে মায়ের বোধন। বৃহস্পতিবার পালিত হবে মহাসপ্তমী। কুমারীপূজা ও মহাঅষ্টমীর মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে শুক্রবার। শনিবার মহানবমীতে মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলী দেবেন ভক্তরা। আর রবিবার বিজয়া দশমীর মাধ্যমে শেষ হবে চলতি বছরের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। অকাল বৃষ্টির হাত থেকে প্রতিমা বাঁচাতে প্রায় সবগুলো মণ্ডপে ত্রিপলের ছাউনি তৈরি করা হয়েছে।

নগরীর একটি মণ্ডপে কথা হয় প্রতিমা শিল্পী সুখদেব পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতি বছর পূজার তিন মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজে তার ব্যস্ততা শুরু হয়। এই কয়েক মাস দিনরাত কাজ করতে হয়। তার ১০ জনের একটি টিম রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে ৫ জন কাজ করে। বাকি পাঁচজন কাজ করছে অন্য আরেকটি মÐপের প্রতিমা তৈরিতে। আর মাত্র ১ দিন বাকি আছে দুর্গাপূজার। প্রতিমা প্রায় তৈরি। এখন শুধু রং দিয়ে সৌন্দর্যবর্ধিত করতে হবে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা জানান, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর অনেকেই এবার পূজার আয়োজন নিয়ে ছিলেন উদ্বিগ্ন। কিন্তু সব আশংকা কাটিয়ে উৎসবের আমেজে মেতেছে পুরো দেশ। অন্যান্য বছর নানান রকমের হুমকি-ধামকি চলতি বছর এমন কোনো কিছু পাওয়া যায় নি জানিয়ে বাংলাদেশ পূজা উৎযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা জনকণ্ঠকে বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি পূজা মণ্ডপে, হিন্দুদের বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চহয়েছে। কিন্তু এবার এরকম কোনো আশংকা নেই বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রত্যেক মণ্ডপে লাগানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।

রাজধানীর সব  ম্যাপেই সিসিটিভি ক্যামেরাসহ সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এগুলোর সবগুলোর কাজই প্রায় সম্পন্ন। রাজধানীর বাইরেও স্থায়ী  ম্যাপগুলোতেও ক্যামেরা বসানো হয়েছে। শুধুমাত্র কিছু অস্থায়ী কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা এখনো বসানো সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এগুলোও সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসার। তবে সিসিটিভি না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ তৎপর থাকবে বলে আমাদের আশ্বস্থ করেছেন। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরাও প্রস্তুত রয়েছেন।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আশ্বস্ত করেছেন খোদ সেনাপ্রধানও। গত শনিবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সবাই নির্ভয়ে পূজাম্যাপে   যাবেন। সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। সবাই যার যার ধর্ম সেই সেই পালন করবেন। সেজন্য যা কিছু করতে হয় তা আমরা করবো। আমরা মাঠে আছি। আপনারা নির্ভয়ে পূজাম্যাপে  যাবেন, পূজা করবেন। তিনি বলেন, আপনাদের কোনো ভয় পাওয়ার কারণ নেই, সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে, আমি বিশেষভাবে বলে দিয়েছি। এ সময় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের সভাপতিসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। 

একই আশ্বাস দিয়েছেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদও। একই দিন অন্য এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি পূজাম্যাপের  ২ লাখ ১২ হাজার ১৯২ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার-ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হবে। তারা ৮ অক্টোবর অর্থাৎ মঙ্গলবার থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ৬ দিন পূজাম্যাপের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপ গুলোতে ৮ জন এবং গুরত্বপূর্ণ ম্যাপে  ৬ জন ও সাধারণ ম্যাপে  ৬ জন করে আনসার-ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হবে। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাপের মধ্য থেকে ১৫ হাজার ৩২টি ম্যাপে  ৫৩ হাজার ১৪৮ জন আনসার-ভিডিপি সদস্য ৬ ও ৭ অক্টোবর পর্যন্ত কাজ করবে। পূজার নিরাপত্তায় এ বছর প্রথমবারের মতো স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে ব্যাটেলিয়ন আনসার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সারাদেশে ৬৪টি জেলায় যেকোনো আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাটালিয়ন আনসারদের মোট ৯২টি টিম মোবাইল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। প্রতিটি টিমে ৬ জন করে সদস্য থাকবে।

আইনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন আশ্বাস পেয়ে খুশি সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও। রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা অর্জুন সূত্রধর বলেন, প্রতিবছর পূজা উদযাপনে গ্রামের বাড়িতে যেতাম। কিন্তু এ বছর নানা কারণে যাওয়া হবে না। কিন্তু ঢাকায়ও পূজার আনন্দ পাবো কি না তা নিয়ে ছিলো শংকা। কিন্তু সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে সব শংকা কেটে গেছে। 
এদিকে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো। অনেকেই পূজার মূল কেনাকাটা শেষ করেছেন আগেভাগে, এখন আসছেন শেষ মুহূর্তের আনুষঙ্গিক কেনাকাটা সারতে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে এই কেনাকাটা। শুধু বিপনিবিতান নয় পাশপাশি ফুটপাতের কেনাকাটাও জমজমাট। ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানে দেয়া হয়েছে বিশেষ ছাড়। দুর্গাৎসবকে ঘিরে বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের বাহারি রঙের পোশাকে সেজেছে বুটিক হাউসগুলো।

শারদীয় উৎসবের চিরন্তন রূপ তুলে ধরে ত্রিশুল, ওম ও দেবী দুর্গার ছবি আঁকা লাল সাদার পাশাপাশি বর্ণিল রঙের প্রাধান্য দেখা গেছে শাড়ি ও পাঞ্জাবিতে।
রাজধানীর মৌচাক মার্কেটে স্বামীর সঙ্গে পূজার কেনাকাটা করতে এসেছেন প্রেয়াশা শর্মা। সবে প্রায় ১০ টা দোকান ঘুরে সবে মাত্র একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছে। ঠিক কখন সব কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরতে পারবেন না জানলেও পূজার আসছে সেই আনন্দে উচ্ছসিত তার চোখমুখ। 

ক্রেতাদের সমাগমে মুখর রাজধানীর ফ্যাশন হাউজগুলোও। মগবাজার আড়ংয়ে স্বপরিবারে কেনাকাটা করতে এসেছেন আদিত্য রায়। বলেন, সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি পূজার দিনগুলোর জন্য। দেশের পরিস্থিতির কারণে এবার পূজা নিয়ে নানা আশংকায় ছিলাম। কিন্তু এখন আর কোনো আশংকা লাগছে না। সবাই মিলে মা দুর্গাকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত আমরা। 

বিক্রেতারা জানান, নারীদের ক্ষেত্রে কাতান শাড়ী, রেশমসিল্ক, মিরপুর কাতান, টাঙ্গাইল শাড়ী, বেনারশি শাড়ী, প্রিন্ট শাড়ী, থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে বেশি। পুরুষ ও শিশুরাও বেঁচে নিচ্ছেন পছন্দের পোশাকটি। কেউ পূজার পাঁচদিনের জন্য আলাদা আলাদা পাঁচ ধরণের পোশাকও কিনছেন।

 রাজধানীর গাউছিয়ার শাড়ির দোকানিরা বলছেন, কাতান, তসর, সিল্ক ও ভারী কাজের শাড়িগুলো পূজায় বেশি চলে। শিপলু নামের এক দোকানি বলেন, শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। দামের ব্যাপারে বলেন, দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। মহামারীর ঘোর অমানিশা পুরোপুরি কেটে আলোর ঝর্ণাধারা ধরণীতে মায়ের আগমনীর মাধ্যমে বয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস তাদের।

বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ৪০৮টি দুর্গাপূজা হয়। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ছিল ২৪৫। সেই তুলনায় এবার বেড়েছে পূজার সংখ্যা। 

এই বছর মহাসপ্তমী বৃহস্পতিবার পড়ায় দেবীর আগমন হবে দোলা বা পালকিতে। শাস্ত্র অনুসারে দোলা বা পালকিতে দেবীর আগমন হলে সূচিত হয় ভয়ঙ্কর মহামারী, যাতে বিপুল প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। আবার ২০২৪-এ বিজয়া দশমী রবিবার পড়ায় এই বছর দেবী ফিরে যাবেন গজ বা হাতিতে। গজ হল দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন, দেবীর আগমন বা গমন হাতিতে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধিতে, ভক্তদের মনের ইচ্ছে পূরণ হয়।

স্বপ্না/টুম্পা

×