ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ০০:১৩, ১০ ডিসেম্বর ২০২২

রাজধানীতে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী

রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থান

বিএনপির গণসমাবেশকে ঘিরে যে কোনো ধরনের নাশকতা-নৈরাজ্য মোকাবিলায় আজ শনিবার রাজধানী ঢাকার জলে, স্থলে, আকাশে নিচ্ছিদ্র  নিরাপত্তার জাল তৈরি করে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেস্টনী তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আকাশে মেশিনগানে সুসজ্জিত হয়ে টার্গেট ফিক্সিং করে রাজধানীর আকাশে চক্কর দেবে হেলিকপ্টার ও ড্রোন। জলে থাকবে নৌপুলিশের চৌকস বাহিনীর সশস্ত্র প্রহরা। স্থলে মোতায়েন থাকবে বিজিবি, র‌্যাব, এপিবিএন, সোয়াত, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের ২০ সহস্রাধিক সদস্য।
ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) চোখে রাজধানীর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীর রাজপথে নিরাপত্তায় মোতায়েন থাকবে স্টাইকিং ফোর্স, টহল দল, মোবাইল টিম ও গোয়েন্দা। রাজধানীর প্রবেশের সব রাস্তায় চৌকি বসিয়ে আগন্তুকদের তল্লাশি করা হবে। রাজধানী ঘিরে যদি অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেটার জন্য অ্যাম্বুলেন্স, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্স, স্পেশাল ডগ স্কোয়াড, জল কামান, সাঁজোয়া যান, ভিডিও ও স্টিল ক্যামেরাসহ অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে, সে জন্য সার্বক্ষণিক সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে। ঢাকা শহরের  প্রত্যেকটি প্রবেশপথ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, কূটনৈতিক পাড়াসহ সব স্তরে সতর্ক পাহারায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সন্ত্রাসী, জঙ্গি, অপরাধী, দুর্বৃত্ত দলের নাশকতা, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা কঠোর হস্তে দমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এখন রাজধানীর রাজপথে অবস্থান করছে। দুইদিন আগে থেকেই নয়াপল্টন ও আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
আজ ১০ ডিসেম্বর কী হবে, কী হচ্ছে- এমন  প্রশ্ন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যেই ৭ ডিসেম্বরে নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের রক্তক্ষয়ী সহিংস সংঘর্ষে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় রাজধানীর নিরাপত্তা ছক কষেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিএনপির নয়াপল্টনের অফিসের ভেতরে তল্লাশি করে দেড় শতাধিক বস্তা চাল, বোমা, বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি। হেফাজতিরা ‘১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বর দখল করে রাজধানীজুড়ে সন্ত্রাসের তা-বলীলা চালিয়ে রাজধানী দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই একই কায়দায় ১০ ডিসেম্বরে নয়াপল্টনে গণসমাবেশের নামে সরকার উৎখাতের নীল-নক্সা তৈরি করে নাশকতা, নৈরাজ্য চালানোর নীল-নক্সা তৈরি করা হয়েছিল বলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ৭ ডিসেম্বরে নয়াপল্টনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হতাহত, গ্রেপ্তার, মামলা দায়ের ইত্যাদি অপ্রীতিকর ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ১০ ডিসেম্বর আসার আগে থেকেই জনমনে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়।
সারাদেশে বিভাগীয় শহরে ধারাবাহিক গণসমাবেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সব শেষে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিভাগীয় গণসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। বলা হচ্ছে, কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হবে এদিন। কেউ বলছে ১০ লাখ, কেউ বলছে ২০ লাখ নেতাকর্মী জমায়েত হবেন ঢাকায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে সরকার। বিএনপি বলছে, যে কোনো মূল্যে রাজধানীর নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুমতি ছাড়া বেআইনিভাবে বিএনপি নয়াপল্টনের সমাবেশ করার প্রস্তুতি নিয়ে ৭ ডিসেম্বরে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে-বাইরে অবস্থান নেয় হাজার হাজার নেতাকর্মী। ১০ ডিসেম্বরের আগেই নয়াপল্টন দখলে নেওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দিলে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে একজন নিহত ও পুলিশসহ শতাধিক আহত হন। সমাবেশস্থল নয়াপল্টন দখলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
গোয়েন্দা সংস্থার  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে তৃতীয় পক্ষ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির ভয়ংকর পরিকল্পনা নিতে পারে। তৎপর হয়ে উঠতে পারে অশুভ শক্তি। মুখে ভিন্ন কথা বললেও জামায়াত-শিবির মহাসমাবেশে অংশ নেবে- এমনটাই ধরে নিতে হবে। তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠীও। নয়াপল্টন এলাকা বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এবং প্রতিটি অলি-গলিতে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার রয়েছে, যারা অতীতে নাশকতা, নৈরাজ্য ও আগুন-সন্ত্রাস চালিয়েছে বলে জানা গেছে।’
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসবে, তাদের নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নিয়ে পুরো রাজধানীকে অচল করে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা থাকাটাই স্বাভাবিক।

লক্ষাধিক মানুষের পদভারে ঢাকার রাজপথ যানজটের কবলে পড়ে অচল হয়ে যাবে- এমন পরিস্থিতির বিষয়ে উদ্বিগ্ন আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ। যদিও বিএনপি বলেছে, তারা কোনো সহিংস কার্যক্রম করবে না। তারা স্রেফ একটি সমাবেশ করবে মাত্র। কিন্তু ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নেতাকর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত কর্মিসভাগুলোতে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে, ১০ ডিসেম্বর নেতাদের নির্দেশ ছাড়া কোনো কর্মী যেন সেদিন সমাবেশস্থল ত্যাগ না করে। আর কর্মীদের যেখানে বাধা দেওয়া হবে, সেখানে যেন তারা প্রতিবাদ করে। এ সমস্ত ঘটনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি পুরো ঢাকা শহরকে অবরুদ্ধ করে একটি সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করার ছক কষেছে। সুতরাং, এটা সুস্পষ্ট যে, ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে একটি ভয়ংকর পরিকল্পনায় সামনে এগোচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, সমাবেশ করতে বাধা নেই। যেখানে অনুমতি দেওয়া হবে, সেখানে সমাবেশ করতে হবে। বিএনপির সমাবেশ ঘিরে যাতে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য রাজধানী ঢাকার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ  প্রস্তুত থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা শহরের প্রত্যেকটি  প্রবেশ পথ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, কূটনৈতিক পাড়াসহ সব স্তরে সতর্ক পাহারায় থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গোয়েন্দা সংস্থা সার্বিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন। যারা বিক্ষোভ, মিছিল-সমাবেশের নামে নাশকতার চেষ্টা করবে, জ্বালাও-পোড়াও করবে, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। কেউ যদি যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে, জানমালের ক্ষতির চেষ্টা করে, থানায় হামলা বা আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেছেন, বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে খোলা মাঠ ছাড়া রাস্তাঘাটে কোনো সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না। ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ সামনে রেখে সমাবেশস্থল নির্ধারণ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার এ সব কথা বলেন। তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপিকে সমাবেশের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কারণ, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্যানটি নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। পরে অবশ্য দফায় দফায় বৈঠকের পর বিএনপির প্রস্তাব অনুযায়ী রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে নির্ধারিত সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে ডিএমপি।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির পূর্বনির্ধারিত ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে যে কোনো ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে র‌্যাব। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, স্পেশাল ফোর্স, স্পেশাল ডগ স্কোয়াড ও হেলিকপ্টার ইউনিটসহ সব ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত। নাশকতার পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, সে জন্য সাদা পোশাকেও থাকবেন র‌্যাবের গোয়েন্দা সদস্যরা।
রাজধানীর কাওরান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সব কথা বলেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা সবসময় সচেষ্ট। শুধু এই জনসমাবেশ ঘিরে নয়, র‌্যাব সবসময় জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষাসহ দেশের ভাবমূর্তি যেন কখনো বিদেশীদের কাছে ক্ষুণœ না হয়, সেদিকে সচেষ্ট থাকে। যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‌্যাবের সব ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তার দাবি।

 

×